
ছবি: সংগৃহীত
দেশে গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে গঠিত তদন্ত কমিশনের কার্যকাল ছয় মাস বাড়িয়ে আগামী ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত বর্ধিত করেছে সরকার। এই সময়সীমা ২০২৫ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে। সোমবার (২৩ জুন) সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে এ সংক্রান্ত একটি গেজেট প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে করে গুমের ঘটনার তদন্ত ও তথ্য সংগ্রহে গঠিত এই বিশেষ কমিশন তাদের কাজ চালিয়ে যাওয়ার আরও সময় পেল।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সরকার Commissions of Inquiry Act, 1956 (Act No. VI of 1956) এর Section 3 এর আওতায় পূর্বে ২০২৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর যে প্রজ্ঞাপন জারি করে গুম তদন্ত কমিশন গঠন করেছিল, তার মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হলো। এই নতুন প্রজ্ঞাপন ১ জুলাই থেকে কার্যকর ধরা হবে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, কমিশনটির কাজ মূলত ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২3 সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে গুম হওয়া ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা, তাদের বর্তমান অবস্থান নির্ধারণ করা এবং তাদের গুম হওয়ার পরিপ্রেক্ষিত ও প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করা।
এই তদন্ত কমিশনের কাজের আওতায় রয়েছে দেশের সকল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে ওঠা গুমের অভিযোগ যাচাই ও তদন্ত করা। এর মধ্যে রয়েছে— বাংলাদেশ পুলিশ, র্যাব (র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন), বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ), সিআইডি (ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট), এসবি (স্পেশাল ব্রাঞ্চ), ডিবি (ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ), আনসার ব্যাটালিয়ন, এনএসআই (জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা), ডিজিএফআই (প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর), বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড, এবং সশস্ত্র বাহিনীর সংশ্লিষ্ট ইউনিটসমূহ।
কমিশন এসব বাহিনীর সংশ্লিষ্টতায় গুম হওয়া বা নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের তথ্য, অবস্থান ও ঘটনার পটভূমি নির্ধারণে কাজ করছে।
কমিশনটি গঠিত হয়েছে পাঁচ সদস্য নিয়ে। এতে সভাপতি হিসেবে আছেন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী। অন্যান্য সদস্যরা হলেন— হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী, মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাবিলা ইদ্রিস এবং মানবাধিকার সংগঠক সাজ্জাদ হোসেন।
এই কমিশন ইতোমধ্যে তাদের কার্যক্রম শুরু করে গুম সংক্রান্ত ঘটনা, প্রমাণ ও সাক্ষ্য গ্রহণের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন পরিবার ও মানবাধিকার সংগঠনের কাছ থেকেও তথ্য গ্রহণ করা হচ্ছে।
কমিশনের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন প্রস্তুত করে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। এতে গুম সংক্রান্ত প্রাথমিক তথ্য, তদন্ত প্রক্রিয়ার অগ্রগতি এবং ভবিষ্যৎ করণীয় বিষয়ে সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
কমিশনের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, “এই কাজ খুবই সংবেদনশীল ও মানবিক। অনেক পরিবার বছরের পর বছর নিখোঁজ স্বজনের খোঁজে অপেক্ষা করছে। আমাদের কমিশনের দায়িত্ব সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা।”
কমিশনের মেয়াদ বৃদ্ধিকে স্বাগত জানিয়েছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন। তাদের মতে, এই কমিশন শুধু নিখোঁজদের খোঁজই দেবে না, বরং রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতার এক গুরুত্বপূর্ণ নজির হিসেবেও কাজ করবে। তবে তারা চায়, এই তদন্ত যেন শুধুমাত্র আংশিক না হয়ে প্রকাশ্য ও কার্যকর ফলাফল নিয়ে আসে।
বাংলাদেশে গুমের ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলে বহুবার আলোচনায় এসেছে। জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এই বিষয়ে স্বচ্ছ তদন্ত ও প্রকাশ্য তথ্য চেয়েছে। কমিশনের কার্যক্রম আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবেলায় সরকারের একটি পদক্ষেপ হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ