
ছবি: সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক উত্তেজনায় ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে সংঘাত আবারও বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে। ইসরাইলের টানা ১২ দিনের বিমান হামলার পর যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানোর ঘটনায়, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা প্রশ্ন তুলছেন—এই সংঘাতের ফলাফল আসলে কী? বিশেষ করে ইসরাইলের যুদ্ধঘোষণার পেছনে যেসব উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য ছিল, সেগুলোর একটিও কি অর্জিত হয়েছে? আল-জাজিরায় প্রকাশিত এক সুদীর্ঘ প্রবন্ধে ইসরাইলি রাজনৈতিক ভাষ্যকার এবং মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক অরি গোল্ডবার্গ দাবি করেছেন, ইসরাইল প্রকৃতপক্ষে কৌশলগতভাবে ইরানের কাছে ধরাশায়ী হয়েছে।
তিনি বিশ্লেষণ করেছেন, কীভাবে ইসরাইল সরকারের উচ্চাভিলাষী সামরিক কৌশল ব্যর্থ হয়েছে, কেন ইরান এই সংঘাত থেকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে, এবং বিশ্ব সম্প্রদায় কোন দিকে অবস্থান নিয়েছে।
ইসরাইলের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য: বাস্তবতা কতটা অর্জিত?
ইসরাইল সরকার যুদ্ধ শুরু করেছিল একাধিক ঘোষিত লক্ষ্য নিয়ে—
১. ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির লাগাম টানা
২. শাসকগোষ্ঠীতে ফাটল ধরানো বা সরকার পরিবর্তনের উদ্যোগ
৩. অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ উসকে দেওয়া
৪. আন্তর্জাতিক সমর্থন নিশ্চিত করা
৫. গাজা সংকট থেকে দৃষ্টি সরানো
কিন্তু গোল্ডবার্গ মনে করেন, এই প্রতিটি লক্ষ্যই ভেস্তে গেছে। তিনি বলেন, “ইসরাইল যুদ্ধ শুরু করেছিল প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে, কিন্তু শেষমেশ তারা যা পেল তা হলো ব্যাপক ক্ষতি, আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনা, এবং কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা।”
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে অরি গোল্ডবার্গ বলেন, “ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালালেও তা কার্যত নিষ্প্রভ হয়েছে। কারণ, ইরান আগেই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সরিয়ে ফেলেছিল। ফলে ফোর্ডো ও নাতাঞ্জের মতো স্থাপনাগুলোর ক্ষতি কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবিক ক্ষতি প্রায় নেই।”
ইসরাইল এমনকি বাঙ্কার-বাস্টার ‘ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর’ ব্যবহারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে রাজি করিয়েছিল। কিন্তু হামলার পরে মার্কিন কৌশলগত বোমারু বিমানগুলো ফিরে যায়, এবং এতে বোঝা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগতভাবে সম্পূর্ণ যুক্ত ছিল না।
গোল্ডবার্গ বলেন, “ইসরাইলের আরেকটি লক্ষ্য ছিল ইরানের সামরিক ও গোয়েন্দা কাঠামোতে শীর্ষ নেতাদের হত্যা করে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ উসকে দেওয়া। কিন্তু ইতিহাস বলছে, এমন হত্যাকাণ্ড বরং শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ কমিয়ে দেয়।”
এই ক্ষেত্রে ইরান ব্যতিক্রম নয়। বহু ইরানি, যারা সরকারের সমালোচক, তারাও এই পরিস্থিতিকে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় হিসেবে দেখে সরকারকে সমর্থন করতে বাধ্য হয়েছে। গোল্ডবার্গের ভাষায়, “ইসরাইল সরকার ভেবেছিল তারা শত্রু শিবিরে ফাটল ধরাবে, কিন্তু তারা বরং তাদের ঐক্য আরও মজবুত করে তুলেছে।”
বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ইসরাইল এভিন কারাগার এবং আইআরআইবি (ইরান রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম) লক্ষ্য করে যেসব হামলা চালিয়েছে, তা ছিল বেপরোয়া এবং কৌশলগতভাবে ভুল। ইসরাইল সেসব হামলাকে “প্রতীকী হামলা” হিসেবে দেখালেও এর ফল হয়েছে উল্টো। এভিন কারাগারের বন্দিদের অনেককে সরিয়ে নেওয়া হয়, পরিস্থিতি হয় আরও কঠিন। আর রাষ্ট্রীয় টিভিতে হামলা ইরান সরকারকে বরং আরও বেশি করে জনগণকে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দিয়েছে।
গোল্ডবার্গ প্রশ্ন তুলেছেন—ইসরাইল কি অন্তত বিশ্ব সম্প্রদায়কে তাদের পাশে আনতে পেরেছে? উত্তর—না। যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্প হামলায় সমর্থন দিয়েছিলেন এবং কিছু পশ্চিমা নেতা ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু ইসরাইলের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংসের দাবিকে কেউ স্বীকৃতি দেয়নি।
বিশ্ব এখন ‘নন-প্রোলিফারেশন’ বা পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ নীতিতে ফিরে যাচ্ছে। ইউরোপীয় দেশগুলোও চাইছে ইরানের সঙ্গে নতুন বাণিজ্যিক সম্পর্ক। বিশ্ব ইরানকে এখন একটি কার্যকর কৌশলগত অংশীদার হিসেবে দেখতে শুরু করেছে।
ইসরাইলের আরেকটি অনুচ্চারিত লক্ষ্য ছিল গাজার গণহত্যা ও মানবিক বিপর্যয় থেকে বিশ্বদৃষ্টি সরিয়ে নেওয়া। গোল্ডবার্গের মতে, ইরান-ইসরাইল সংঘাত তা পারেনি। বরং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো আরও বেশি করে ইসরাইলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের রেকর্ডগুলো সামনে আনছে।
গোল্ডবার্গের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, ইরানের প্রতিরোধ ছিল অনেক বেশি সংগঠিত, ধৈর্যশীল এবং কৌশলগত।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইসরাইলের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা Iron Dome ও Arrow ভেদ করে মূল শহরগুলোতে আঘাত হানে।
ইসরাইলি অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ইন্টারসেপ্টর মিসাইলের ঘাটতিতে সামরিক সাড়া পড়তে থাকে।
ইরানের কূটনৈতিক অবস্থান শক্ত হয়—চীন, রাশিয়া, এমনকি কিছু ইউরোপীয় শক্তি এ সংঘাতে মধ্যপন্থা নেয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান নিজেকে এখন শুধু একটি প্রতিরোধী রাষ্ট্র নয়, বরং যুদ্ধ-পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্যে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য প্রস্তুত একটি কৌশলগত শক্তি হিসেবে তুলে ধরেছে।
গোল্ডবার্গের মন্তব্যে স্পষ্ট, ইসরাইল যদি ভেবেছিল তারা এক নজরে ইরানকে দুর্বল করে দেবে, তবে তারা মারাত্মকভাবে ভুল করেছিল। এই যুদ্ধ দেখিয়েছে—ইরান শুধু প্রতিরোধ গড়তে পারে না, বরং যুদ্ধের পরবর্তী অবস্থানেও নিজেকে শক্তিশালী করে তুলতে পারে। বিশ্বজনমত এখন ইসরাইলের চেয়ে ইরানের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠছে, যা ভবিষ্যতের ভূরাজনীতিতে নতুন পালাবদলের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এই ব্যর্থতা নেতানিয়াহু সরকারের জন্য কেবল একটি সামরিক বিপর্যয় নয়, এটি ইসরাইলের কৌশলগত পরিকল্পনার ওপরও বড় একটি প্রশ্নচিহ্ন রেখে দিয়েছে। আর ইরানের জন্য এটি এক কথায়—“বিষয়টি এখন কেবল প্রতিরোধ নয়, কূটনৈতিক বিজয়ও।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ