
ছবি: সংগৃহীত
চীনের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে পাঁচ দিনের সফরে রোববার রাত ১০টা ১০ মিনিটে ঢাকা ছেড়েছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) থেকে ৯ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল চীনের উদ্দেশে যাত্রা করেছে। এ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে রয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উড্ডয়নের আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মির্জা ফখরুল জানান, চীন সফরের মূল উদ্দেশ্য হলো দুই দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন, পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে মতবিনিময়। তিনি বলেন, “চীন একটি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ, প্রযুক্তিনির্ভর ও বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাবশালী দেশ। তাদের অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতা থেকে আমাদের শেখার অনেক কিছু আছে। যদি এই সম্পর্ককে কার্যকরভাবে কাজে লাগানো যায়, তাহলে বাংলাদেশের উন্নয়নেও তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
বিএনপি মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান নিশ্চিত করেছেন, দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে গঠিত এ প্রতিনিধি দলে রয়েছেন— স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সেলিমা রহমান, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন, ঈসমাইল জবিউল্লাহ, সুকোমল বড়ুয়া, বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক অধ্যাপক মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব এবিএম আব্দুস সাত্তার।
এই প্রতিনিধিদলের সদস্যরা চীনে অবস্থানকালে বেইজিংসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শহরে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেবেন এবং চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে একাধিক দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জানান, “চীন সফরে মূলত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার পাশাপাশি পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধির বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশ-চীন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভবিষ্যৎ রূপরেখা কেমন হওয়া উচিত, সেই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে।”
তিনি আরও বলেন, “চীন এখন বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম প্রভাবশালী শক্তি এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চীনের যে নীতি ও উন্নয়ন ভাবনা রয়েছে, আমরা সেটি জানতে ও নিজেদের অবস্থান তুলে ধরতেই এই সফরে যাচ্ছি।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সাম্প্রতিক সময়ে চীন বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে যে উদ্যোগ নিচ্ছে, তারই অংশ হিসেবে বিএনপির এই সফর গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে চীন আগ্রহভরে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে বলেও মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।
চীনের সঙ্গে অতীতে আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও, সাম্প্রতিক সময়ে বিরোধী দলগুলোর সঙ্গেও তারা সংলাপে বসছে, যা দেশটির বহুমাত্রিক কূটনীতির অংশ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
চলতি বছরের মে মাসের শেষদিকে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সম্মেলনে বিএনপির প্রতিনিধি দল অংশ নেয়। সেই সম্মেলনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, উত্তর-পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপে অংশ নেয় বিএনপি নেতারা। সেখানে আঞ্চলিক সহযোগিতা, অভিন্ন অর্থনৈতিক উদ্যোগ ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে আলাপ হয়।
তৎকালীন ওই সফর থেকেই বিএনপি ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে নতুন করে সম্পর্ক গড়ে উঠছে বলে ধারণা করা হয়। এবারের সফর সেই সম্পর্কের একটি আনুষ্ঠানিক ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
?
এ সফরের মাধ্যমে বিএনপি আন্তর্জাতিক মহলে নিজের রাজনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করতে চাইছে বলেই মনে করা হচ্ছে। চীন, রাশিয়া, ভারতসহ বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে সক্রিয় কূটনৈতিক যোগাযোগ রাখার মধ্য দিয়ে দলটি নিজেদের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ও পরবর্তী রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণে সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে সচেষ্ট।
বিশেষ করে ২০২৪ সালের বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচন এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর উদ্ভূত নতুন বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক মহলের কাছে নিজেদের ভূমিকা ও অবস্থান স্পষ্ট করতে চায় বিএনপি। চীন সফর তারই একটি পর্ব।
বিএনপি নেতাদের চীন সফর নিছক একটি সৌজন্য সফরের গণ্ডি পেরিয়ে এখন একটি কৌশলগত রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক উদ্যোগে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সমীকরণে এই সফর কতটা প্রভাব ফেলবে, তা নির্ভর করবে সফরকালীন আলোচনার গভীরতা ও ফলপ্রসূতার ওপর। তবে এটুকু নিশ্চিত—বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের অবস্থান জোরদারে সক্রিয় উদ্যোগ নিচ্ছে এবং চীনকে তার এক কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ