
ছবি: সংগৃহীত
দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের অগ্রগতিতে। অর্থবছরের ১১ মাস পেরিয়ে গেলেও সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (আরএডিপি) বাস্তবায়ন মাত্র ৪৯ শতাংশে এসে ঠেকেছে, যা বিগত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অগ্রগতি হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) জুন-প্রকাশিত সর্বশেষ মাসিক অগ্রগতি প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে সংশোধিত এডিপির আওতায় মোট বরাদ্দ রয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা। অথচ গত ১১ মাসে (জুলাই ২০২৪ থেকে মে ২০২৫ পর্যন্ত) প্রকল্পগুলোয় ব্যয় হয়েছে মাত্র ১ লাখ ১১ হাজার ৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরের প্রায় শেষপ্রান্তে এসেও অর্ধেক অর্থই ব্যয় করা যায়নি।
সংশ্লিষ্ট তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত অর্থবছর ২০২৩-২৪ সালের একই সময়ে আরএডিপির বাস্তবায়ন হার ছিল ৫৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ। তার আগের অর্থবছরে, অর্থাৎ ২০২২-২৩ সালে এ হার ছিল ৬১ দশমিক ৭৩ শতাংশ এবং ২০২১-২২ সালে ৬৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এরও আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে ১১ মাস শেষে বাস্তবায়ন হয়েছিল ৫৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরে বাস্তবায়ন হার কেবল আগের বছরের চেয়ে নয়, ধারাবাহিকভাবে বিগত চার বছরের তুলনায়ও অনেক পিছিয়ে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় একটি বড় ধরনের গলদ এবং সক্ষমতার সংকটকে স্পষ্ট করে। মূল সমস্যা হিসেবে তাঁরা দেখছেন—প্রকল্প পরিকল্পনার দুর্বলতা, অর্থ ছাড়ের ধীরগতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং যথাসময়ে প্রকল্প পরিচালকদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব।
আইএমইডির তথ্যমতে, জুন মাসের মধ্যে শতভাগ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে, এক মাসেই ব্যয় করতে হবে প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা—যা এক মাসে খরচের জন্য অত্যন্ত বিশাল অঙ্ক। বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা স্বীকার করছেন, প্রকল্পগুলোর কাজ অনেকটাই শেষ হলেও বিল পরিশোধ না হওয়ায় তা এখনও আর্থিক প্রতিবেদনগুলোতে প্রতিফলিত হয়নি। ফলে জুনে এইসব বিল পরিশোধ হলে বাস্তবায়নের হার কিছুটা বেড়ে যেতে পারে।
তবে বিশেষজ্ঞরা এটিকে স্বস্তিদায়ক কোনো বিষয় মনে করছেন না। অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “বছরের শেষ দিকে অতিমাত্রায় প্রকল্প ব্যয় বেড়ে গেলে দুর্নীতি, অনিয়ম, নিম্নমানের কাজ এবং অপ্রয়োজনীয় খরচের আশঙ্কা থাকে। কারণ তখন বাস্তব কাজ না করে কাগজে দেখিয়ে অগ্রগতি দেখানোর প্রবণতা বাড়ে।”
যদিও সামগ্রিকভাবে এডিপি বাস্তবায়নে অগ্রগতি ধীর, তবে কিছু মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তুলনামূলকভাবে ভালো করেছে। আইএমইডি বলছে, অন্তত ১১টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের আরএডিপি বাস্তবায়ন হার ৭০ শতাংশের ওপরে রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—বিদ্যুৎ বিভাগ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ, কৃষি মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ, লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ এবং সংসদ সচিবালয়।
বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অগ্রগতি তুলনামূলক ভালো। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো জানিয়েছে, এই খাতে বড় বড় অবকাঠামোগত প্রকল্প রয়েছে, যেখানে নিয়মিত মনিটরিং এবং উচ্চ পর্যায়ের নজরদারির কারণে বাস্তবায়নে ভালো অগ্রগতি হয়েছে।
অন্যদিকে, কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বাস্তবায়ন হার অত্যন্ত হতাশাজনক। এর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন হার ১০ শতাংশেরও নিচে রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ খাতে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে এ ধরনের গাফিলতি দীর্ঘমেয়াদে দেশের জনস্বাস্থ্য ও মানবসম্পদ উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশেষ করে স্বাস্থ্যখাতের এই দুর্বলতা এমন এক সময়ে, যখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ডেঙ্গু ও অন্যান্য রোগের প্রকোপ বাড়ছে এবং চিকিৎসা অবকাঠামোর ঘাটতি তীব্র আকার ধারণ করেছে।
এডিপি বাস্তবায়নে এ ধস প্রকৃতপক্ষে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কাঠামোগত দুর্বলতাকেই সামনে নিয়ে এসেছে। উন্নয়ন পরিকল্পনার ঘাটতি, ব্যয়ের অনুপযোগী প্রকল্প গ্রহণ, বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর সক্ষমতার অভাব এবং সমন্বয়ের অভাব বারবার এই ধরণের পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, উন্নয়ন ব্যয়ের গুণগত মান বজায় রাখা এবং সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। তদারকির স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে প্রতিবছরই শেষ সময়ে ‘হিড়িক’ তুলে উন্নয়ন খরচ দেখানো হলেও তার প্রকৃত সুফল মিলবে না।
উপসংহার
চলতি অর্থবছরের আরএডিপি বাস্তবায়নের চিত্র উদ্বেগজনক। বছরের প্রায় শেষ দিকে এসে মাত্র ৪৯ শতাংশ ব্যয় শেষ হওয়া এই সংকেত দেয় যে, উন্নয়ন কার্যক্রম কেবল পরিকল্পনা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ, বাস্তবায়নে তেমন গতি নেই। আর এই ধীরগতির মূল্য দিতে হচ্ছে দেশের জনগণকে—অপূর্ণ অবকাঠামো, অসমাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা এবং ধীরগতি প্রকল্পের কারণে। এখন প্রয়োজন প্রকল্পের সংখ্যার চেয়ে গুণগত মানের দিকে নজর দেওয়া এবং প্রকৃত চাহিদাভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ। না হলে বাজেট শুধু অঙ্কের খেলায় সীমাবদ্ধ থেকে যাবে, আর উন্নয়ন জনগণের নাগালে পৌঁছাবে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ