
ছবি: সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, ঠিক সেই মুহূর্তে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামে নাটকীয় উত্থান দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাতের ফলে বিশ্বব্যাপী তেলের সরবরাহ নিয়ে নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতির সরাসরি প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে।
রবিবার আন্তর্জাতিক বাজারে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ৮০ ডলারে পৌঁছেছে, যা আগের দিনের তুলনায় প্রায় ৩ দশমিক ৯ শতাংশ বৃদ্ধি। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব মানদণ্ড অনুযায়ী ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (WTI) তেলের দাম ৪ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ব্যারেলপ্রতি ৭৭ ডলারে। এই হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধিকে বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন “ঝড়ের পূর্বাভাস”, যা শুধু জ্বালানি খাত নয়, বরং শেয়ারবাজার, বন্ডবাজার, মুদ্রাবাজার এবং বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলকেও প্রভাবিত করতে শুরু করেছে।
তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আশঙ্কা বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতি পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ফেডারেল রিজার্ভ) আবারও সুদের হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে—এই সম্ভাবনার কারণে শেয়ারবাজারে চরম উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে।
বিশেষ করে এসঅ্যান্ডপি ৫০০ ইনডেক্সের ফিউচারের দাম ০ দশমিক ৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। প্রযুক্তি খাতের সূচক নাসডাক ফিউচারেও দুর্বলতা দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে মার্কিন ট্রেজারি বন্ডের দাম সামান্য কমে গেছে, যার অর্থ দীর্ঘমেয়াদি সুদের হারের ওপর চাপ বাড়বে।
মূলত, ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব এবং তার পরিণতিতে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাই এখন বাজারে তেলের দামের প্রধান চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছে। ইরান গত কয়েক দিনে সরাসরি ইসরায়েলের অভ্যন্তরে হামলা চালিয়েছে, এবং পালটা জবাবে ইসরায়েলও একাধিকবার ইরানের সামরিক স্থাপনায় আঘাত হেনেছে। এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রও ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করেছে।
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল উৎপাদনকারী দেশ ইরান শুধু উৎপাদক নয়, বরং একটি কৌশলগত অবস্থানে অবস্থিত। দেশটির দক্ষিণে অবস্থিত ‘হরমুজ প্রণালী’ হলো বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক পথগুলোর একটি।
এই প্রণালী দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল পরিবহন হয়, যা বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহের প্রায় ৩০ শতাংশ। অথচ গতকালই ইরানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা এই প্রণালী সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই ঘোষণাই এক লহমায় পুরো জ্বালানি বাজারে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।
বিশ্ববাজারে তেলের দামে বড় উত্থানের সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে হরমুজ প্রণালী বন্ধের আশঙ্কা। ইরান যদি বাস্তবিক অর্থে এই প্রণালী অবরোধ করে, তাহলে শুধু মধ্যপ্রাচ্যের তেল নয়, বরং উপসাগরীয় অঞ্চলের সমস্ত জ্বালানি রপ্তানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে। এই ঘটনা সরাসরি প্রভাব ফেলবে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, চীন, ভারতসহ বিশ্বের শীর্ষ আমদানিকারক দেশগুলোর ওপর।
বিশ্লেষকরা বলছেন, হরমুজ প্রণালী যদি সাময়িক সময়ের জন্যও বন্ধ থাকে, তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে, পরিবহন ব্যয় বাড়বে এবং মুদ্রাস্ফীতির নতুন ঢেউ বইবে।
তেলের দাম বাড়া মানেই জ্বালানি ব্যয় বাড়া। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতে এর সরাসরি প্রভাব পড়ে ভোক্তা পর্যায়ে খরচে, উৎপাদন খরচে এবং আমদানি খরচে। যদি এই পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ বাধ্য হবে আবারও সুদের হার বাড়াতে, যা ইতোমধ্যেই উচ্চ হারের ঋণের বোঝায় জর্জরিত সাধারণ আমেরিকানদের জন্য একটি দুঃসংবাদ।
শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের স্টক মার্কেট বড় ধসের মুখোমুখি হতে পারে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। প্রযুক্তি খাত, পরিবহন খাত এবং উৎপাদন খাত সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
তেলের বাজারে অস্থিরতার কারণে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ বাড়ছে। সৌদি আরব, রাশিয়া, চীন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। চীন ইতোমধ্যেই ‘উদ্বেগজনক পরিস্থিতি’ বলে আখ্যা দিয়েছে এবং কূটনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পরিস্থিতি নিয়ে একটি বৈঠক ডাকা হতে পারে বলে জানা গেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ ব্যর্থ হলে এবং হরমুজ প্রণালীতে কোনো সামরিক সংঘাত ঘটে, তাহলে এই সংকট রূপ নিতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাভাসে।
তেলের বাজারে এই অস্বাভাবিক আগুনের মূল কারণ যুদ্ধ, কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ছে অর্থনীতি ও মানুষের জীবনযাত্রার প্রতিটি স্তরে। যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে এর প্রাথমিক ধাক্কা শুরু হলেও দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব বৈশ্বিক পর্যায়ে আরও গভীর হতে পারে।
বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে—ইরান হরমুজ প্রণালী আসলে বন্ধ করে কিনা, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল কতদূর আগায়, এবং আন্তর্জাতিক মহল কতটা কার্যকরভাবে এই সংকট নিরসনে এগিয়ে আসতে পারে। তার আগে পর্যন্ত, তেলের বাজারে এই অস্থিরতা ও শেয়ারবাজারে ধসের ভয়াবহতা অব্যাহত থাকছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ