
ছবি: সংগৃহীত
ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের আকস্মিক ও সরাসরি বিমান হামলার পর বিশ্বজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও গভীর উদ্বেগ। মধ্যরাতে চালানো এই হামলার নেতৃত্ব দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। হামলার মধ্য দিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের সরাসরি অংশীদার করে তুলেছেন বলে অনেকেই মনে করছেন।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভেতর এই হঠাৎ সামরিক পদক্ষেপ কেবল মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্যও এক অশনিসংকেত হয়ে দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘ, ইউরোপ, এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার বহু রাষ্ট্রনেতা এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, কেউ কেউ সরাসরি নিন্দা জানিয়েছেন এবং বেশিরভাগই আহ্বান জানিয়েছেন উত্তেজনা প্রশমনের।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক টুইটার পোস্টে জানিয়েছেন, তিনি এই হামলায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তার ভাষায়, “এ ধরনের আক্রমণ এমন একটি অঞ্চলে ঘটেছে, যেখানে উত্তেজনা আগে থেকেই তুঙ্গে। এর ফলে পরিস্থিতি খুব দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে, যা সারা বিশ্বের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।”
তিনি বিশ্বনেতাদের প্রতি সতর্কতা ও সংযমের আহ্বান জানান, এবং কূটনৈতিক সমাধানের পথে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার এক বিবৃতিতে বলেন, “ইরানকে কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে দেওয়া যাবে না। যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক হুমকি প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিয়েছে।”
তবে তিনি একইসঙ্গে বলেন, ইরানকে অবশ্যই আলোচনার টেবিলে ফিরতে হবে এবং কূটনৈতিক সমাধানকে প্রাধান্য দিতে হবে।
অস্ট্রেলিয়ার সরকার এক বিবৃতিতে জানায়, “ইরানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি।” কিন্তু হামলার সরাসরি পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নেয়নি।
নিউজিল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইনস্টন পিটার্স বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধি আমাদের গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করেছে। এই উত্তেজনা যেন আরও না বাড়ে, তা নিশ্চিত করা জরুরি।”
মেক্সিকোর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংলাপ এবং কূটনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে। চিলির প্রেসিডেন্ট গাব্রিয়েল বোরিক এক টুইটবার্তায় বলেন, “আমরা শান্তি চাই। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে যেকোনো আক্রমণ আমরা প্রত্যাখ্যান করি।”
ভেনেজুয়েলার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইভান গিল টেলিগ্রামে পোস্টে বলেন, “এটি একটি অবৈধ, অযৌক্তিক ও ভীষণ বিপজ্জনক আগ্রাসন। যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে আগুনে ঘি ঢালছে।”
উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো: কূটনীতির পথেই সমাধান চান
সৌদি আরব এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার ঘটনায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। দেশটি সংযম ও কূটনৈতিক সমাধানের ওপর জোর দিয়েছে। রিয়াদের মতে, সংঘাত এড়াতে অবশ্যই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্যোগী হতে হবে।
ওমান, যেটি অতীতে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছে, এবার সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে ‘আগ্রাসন’ আখ্যা দিয়েছে। ওমানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, “এটি আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের সরাসরি লঙ্ঘন। আমরা সর্বাত্মকভাবে সংঘাত প্রশমনের আহ্বান জানাচ্ছি।”
কাতারও ইরানের ওপর হামলাকে অঞ্চলটির জন্য ভয়াবহ বার্তা হিসেবে উল্লেখ করেছে এবং বলেছে, “এই উত্তেজনা দ্রুত যদি নিয়ন্ত্রণে না আসে, তা হলে আঞ্চলিক যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠবে।”
ইরাকের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, “ইরান আমাদের প্রতিবেশী ও আঞ্চলিক অংশীদার। তার বিরুদ্ধে এমন হামলা পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলবে। আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই। এই হামলা শুধু ইরান নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তার জন্য হুমকি।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত কেবল সামরিক পদক্ষেপ নয়—এটি একটি কৌশলগত মোড় পরিবর্তনের ইঙ্গিতও বহন করে। যুক্তরাষ্ট্র এতদিন ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনায় পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট থাকলেও, সরাসরি হামলা চালিয়ে এখন তারা একেবারে সংঘাতের কেন্দ্রে চলে এসেছে।
এই অবস্থায় বিশ্বনেতাদের উদ্বেগ, আহ্বান ও বিবৃতিগুলো একদিকে যেমন কূটনৈতিক চাপ তৈরি করছে, তেমনি এই সংকট কতটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব, সেটি নির্ভর করছে ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী পদক্ষেপের ওপর। তীব্র উত্তেজনার এই মুহূর্তে কূটনীতি ও শান্তিচেষ্টা কতটা কার্যকর হবে, তা-ই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ