
ছবি: সংগৃহীত
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার জাতীয় বাজেট চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই বাজেট অনুমোদনের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে—দেশ পরিচালনায় অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয় বাড়ানোর দিকে জোর দেওয়া হলেও কালো টাকা বৈধ করার বিতর্কিত সুযোগ এবার থাকছে না।
রোববার (২২ জুন) দুপুরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের এক দীর্ঘ বৈঠকে এই বাজেট প্রস্তাব অনুমোদন পায়। বৈঠকে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাজেটের খসড়া নিয়ে আলোচনা করেন এবং বিভিন্ন উপদেষ্টার মতামতের ভিত্তিতে কিছু সংশোধন ও পুনর্বিন্যাস করে বাজেটের চূড়ান্ত রূপ প্রদান করা হয়।
এবারের বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। অর্থাৎ সংকটকালীন বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে বাজেট কিছুটা সঙ্কুচিত রাখা হয়েছে। বাজেট ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ৬ শতাংশ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর জন্য রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের প্রায় ৬৩ শতাংশ। বাকি অর্থ যোগান দেওয়া হবে বিদেশি ঋণ, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ, এবং উন্নয়ন সহযোগীদের অনুদান থেকে।
প্রথম পর্যায়ে বাজেট উপস্থাপনের সময় (২ জুন) অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত আয়ের অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ রাখার একটি প্রস্তাব তুলে ধরেন। সে সময় বলা হয়, নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে কোনো জিজ্ঞাসা ছাড়াই এই অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হতে পারে।
তবে এই ঘোষণা সামাজিক মাধ্যমে, অর্থনৈতিক বিশ্লেষক মহল এবং রাজনীতিকদের মধ্যে তীব্র সমালোচনার জন্ম দেয়। বিশ্লেষকরা বলেন, “কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বারবার দেওয়া হলে নিয়মিত করদাতারা অবহেলিত বোধ করেন এবং এতে অর্থনৈতিক নৈতিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”
এই প্রেক্ষাপটে বাজেট চূড়ান্তকরণের সময় উপদেষ্টা পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয়, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে কালো টাকা বৈধ করার কোনো সুযোগ রাখা হবে না। এই বিষয়ে বৈঠকে স্পষ্ট করে বলা হয়, এই ধরনের ব্যবস্থা বৈষম্যমূলক এবং দুর্নীতিবাজদের পুরস্কৃত করে।
নতুন বাজেটের প্রধান লক্ষ্য রাখা হয়েছে সাড়ে ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা জোরদারকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে প্রণোদনা অব্যাহত রাখা।
অর্থ উপদেষ্টা জানান, “এটি একটি বাস্তববাদী বাজেট, যেখানে সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষা ও সাধারণ মানুষের স্বস্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায় বাড়ানোর পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে আনাই আমাদের লক্ষ্য।”
বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে। বরাদ্দের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত।
প্রসঙ্গত, সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে এবারই প্রথম বাজেট উপস্থাপন করা হয়। গত ২ জুন টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের মাধ্যমে বাজেটের মূল প্রস্তাব উত্থাপন করেন অর্থ উপদেষ্টা। এরপর সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া, বিশ্লেষকদের মতামত ও উপদেষ্টা পরিষদের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বাজেটের কিছু অংশে পরিবর্তন আনা হয়।
চূড়ান্ত অনুমোদনের পর এই বাজেট এখন সরকারি গেজেট আকারে প্রকাশিত হবে এবং আগামী ১ জুলাই থেকে তা কার্যকর হবে।
চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং মূল্যস্ফীতির চাপে যখন দেশের মানুষ দিশেহারা, তখন একটি পরিমিত, বাস্তবভিত্তিক এবং নৈতিক অবস্থানে দাঁড়ানো বাজেট প্রণয়ন করাকে ইতিবাচক দেখছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তকে অনেকে দেখছেন ‘নৈতিক আর্থিক ব্যবস্থাপনার’ একটি বার্তা হিসেবে।
তবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কতটা দক্ষতা ও স্বচ্ছতা প্রদর্শন করতে পারবে সরকার, সেটাই এখন দেখার বিষয়। এই বাজেট দেশের অর্থনীতিতে কতটা স্বস্তি আনতে পারবে, তা নির্ভর করবে প্রশাসনিক সক্ষমতা, কর আদায়ের গতি এবং বৈদেশিক অনুদান-ঋণের ব্যবস্থাপনার ওপর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ