
ছবি: সংগৃহীত
সরকারি চাকরি সংশোধন বিষয়ক নতুন অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে একটানা আন্দোলন চালিয়ে আসা সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এবার আরও কড়া অবস্থান নিয়েছেন। ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ বাতিলের দাবিতে বড় ধরনের বিক্ষোভ ও কর্মসূচির পর নতুন করে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরাম। আন্দোলনের অংশ হিসেবে তারা সোমবার (২৩ জুন) সচিবালয়ের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মচারীদের নিয়ে দুই ঘণ্টার কর্মবিরতির ডাক দিয়েছেন।
রোববার (২২ জুন) সচিবালয়ের অভ্যন্তরে আয়োজিত এক কর্মী সমাবেশে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন ঐক্য ফোরামের কো-চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, “সরকার যদি তাদের এই কালো আইন বাতিল না করে, তাহলে কর্মসূচি একাধিক ধাপে বিস্তৃত হবে এবং প্রয়োজনে সচিবালয়ের কার্যক্রম পুরোপুরি অচল করে দেওয়া হবে।” তিনি আরও জানান, বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত চলবে এই কর্মবিরতি এবং এ সময় কর্মচারীরা কাজ ছেড়ে অবস্থান করবেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনে সচিবালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে। সেখানে হবে বিক্ষোভ ও আলোচনা সভা। আলোচনা শেষে আগামী দিনের আন্দোলনের রূপরেখা চূড়ান্ত করা হবে।
২০২৫ সালের ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ’ প্রকাশের আগেই সচিবালয়ের কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এই অধ্যাদেশে সরকারি চাকরিজীবীদের চাকরির নিরাপত্তা, পদোন্নতি ও চাকরিচ্যুতির ক্ষেত্রে যে স্বাধীনতা ও ন্যায্যতা তারা এতদিন পেয়ে আসছিলেন, তা একেবারেই সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। তাঁদের ভাষায়, এটি একটি “অবৈধ ও কালো আইন”, যা সরকারি কর্মচারীদের অধিকারকে হরণ করছে।
আন্দোলনকারীরা বলছেন, এই অধ্যাদেশ বাস্তবায়ন হলে কর্মকর্তাদের হাতে কর্মচারীদের বিরুদ্ধে হয়রানি ও খামখেয়ালির সুযোগ বাড়বে। ফলে সচিবালয়ের কর্মপরিবেশ আরও জটিল ও চাপপূর্ণ হয়ে উঠবে। এছাড়া চাকরিচ্যুতির ব্যাপারে শাস্তির বিধান কঠোর ও অস্পষ্ট করা হয়েছে, যেটি মৌলিক অধিকার পরিপন্থী।
গত ২৪ মে থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মচারীরা একযোগে এই আন্দোলন শুরু করেন। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে শুরু হওয়া এই প্রতিবাদে তারা প্ল্যাকার্ড হাতে সচিবালয়ের ভেতরে অবস্থান, স্লোগান এবং কর্মবিরতির মাধ্যমে নিজেদের দাবি তুলে ধরেন। কিন্তু আন্দোলনের মধ্যেই সরকার ২৫ মে অধ্যাদেশটি কার্যকর করে। এই সিদ্ধান্তে আন্দোলন আরও বিস্তৃত আকার ধারণ করে।
ঈদুল আজহার ছুটির পর অফিস খুলতেই ১৭ জুন (সোমবার) থেকে সচিবালয়ের ভেতরে আবারও জোরালো বিক্ষোভ শুরু হয়। সকাল ১১টার দিকে শুরু হওয়া এক বিশাল মিছিলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের শত শত কর্মচারী অংশ নেন। মিছিলটি সচিবালয়ের বিভিন্ন ভবনের বারান্দা ও চত্বর প্রদক্ষিণ করে এবং শেষে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নতুন ভবন (ভবন-১১) এর সামনে গিয়ে অবস্থান নেয়। সেখানে তারা ‘অবৈধ কালো আইন মানি না’, ‘সচিবালয়ের কর্মচারী, এক হও লড়াই কর’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন।
এ সময় অনেককে দেখা যায় সাদা পোশাকে কালো ব্যাজ পরে অংশ নিতে, যার মাধ্যমে তাঁরা অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ জানান।
কো-চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম জানিয়েছেন, “আমরা সরকারকে সময় দিচ্ছি, তারা যদি আমাদের দাবির প্রতি ইতিবাচক সাড়া দেয়, তাহলে আলোচনার পথ খোলা থাকবে। কিন্তু আমাদের দাবির প্রতি কোনো গুরুত্ব না দিলে, আগামী সপ্তাহে লাগাতার কর্মবিরতির দিকে যেতে বাধ্য হবো।”
তিনি আরও বলেন, “এই আন্দোলন আমাদের জীবিকা, নিরাপত্তা এবং পেশাগত মর্যাদার প্রশ্নে। কেউ এটা যেন ভুল না করে যে আমরা ক্লান্ত হয়ে যাব। বরং আমরা আরও সংঘবদ্ধ হচ্ছি।”
এখন পর্যন্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কিংবা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এই বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। যদিও অভ্যন্তরীণভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। আন্দোলনের ভয়াবহতা এবং সচিবালয়ের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমে এর প্রভাব ক্রমশ বাড়তে থাকায় প্রশাসনের উচ্চমহলে এই নিয়ে আলোচনা চলছে।
বাংলাদেশ সচিবালয় দেশের প্রশাসনিক কেন্দ্র। এখানকার কর্মচারীদের টানা আন্দোলন সরকারের দৈনন্দিন কাজকর্ম ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। এ অবস্থায় সরকার কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয় এবং কর্মচারীদের দাবির বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেয়, সে দিকেই তাকিয়ে এখন সবাই। আন্দোলনের পরবর্তী ধাপ নির্ভর করছে সরকারের অবস্থানের ওপর—সমঝোতা, না কি মুখোমুখি সংঘর্ষ? সেই উত্তরের অপেক্ষায় এখন গোটা প্রশাসন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ