
ছবি: সংগৃহীত
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার জাতীয় বাজেটের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। প্রধানমন্ত্রী পদে দায়িত্ব পালনকারী প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে রোববার (২২ জুন) বিকেলে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে বাজেটের খসড়াটি অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয় এবং আলোচনার পর তা চূড়ান্ত রূপে গ্রহণ করা হয়।
সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত দিকটি ছিল কালোটাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার সুযোগ। শুরুতে প্রস্তাবিত বাজেটে অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাট ক্রয় এবং ভবন নির্মাণে নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছিল। তবে ব্যাপক সমালোচনার মুখে শেষ মুহূর্তে সেই প্রস্তাব বাদ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
বাজেট অনুমোদনের কয়েক ঘণ্টা পর, রোববার বিকালে সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে এক বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানান অর্থ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, “ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর বাড়তি ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া বা অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরি করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তাই কালোটাকা সাদা করার মতো অনৈতিক সুবিধা এবার বাজেটে রাখা হয়নি।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা চাই স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে রাজস্ব আদায় হোক। যারা নিয়মিত কর দিয়ে আসছেন, তাদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা রয়েছে। কালোটাকা সাদা করার বিধান রাখলে সৎ করদাতাদের প্রতি অন্যায় করা হতো।”
প্রস্তাবিত বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। বাজেটে রাজস্ব আহরণের প্রধান দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-কে। তাদের জন্য আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা।
বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ, যা পূরণে দেশি-বিদেশি ঋণের পাশাপাশি অনুদান, সঞ্চয়পত্র এবং অন্যান্য আর্থিক উৎস ব্যবহার করা হবে।
নতুন বাজেটে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে সাড়ে ৫ শতাংশ। তবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা, পণ্য মূল্যস্ফীতি ও রপ্তানি আয়ে মন্দার কারণে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “এই বাজেট বাস্তববাদী, মধ্যমেয়াদি সংকট বিবেচনায় পরিকল্পিত এবং জনকল্যাণকেন্দ্রিক। আমাদের লক্ষ্য—মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা।”
প্রসঙ্গত, প্রস্তাবিত বাজেট উন্মোচনের পর কালোটাকা বৈধ করার সুযোগ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে, অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণে ও নাগরিক সমাজের বক্তব্যে প্রবল সমালোচনা উঠে আসে। অনেকেই প্রশ্ন তোলেন—একদিকে সাধারণ নাগরিক ও ব্যবসায়ীদের কর আদায়ে কড়াকড়ি করা হচ্ছে, অন্যদিকে দুর্নীতিবাজদের জন্য সুবিধা দেওয়া হচ্ছে কেন?
এই সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতেই অর্থ মন্ত্রণালয় ১৯ জুন পর্যন্ত বাজেটের ওপর জনমত গ্রহণ করে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সাধারণ নাগরিকরা তাদের মতামত জানাতে পারেন। প্রাপ্ত মতামত ও বিশ্লেষকদের পরামর্শের ভিত্তিতে বাজেটে কিছু সংযোজন-বিয়োজন করে খসড়াটিকে চূড়ান্ত করা হয়।
চূড়ান্ত বাজেট অনুমোদনের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার একটি বার্তা স্পষ্টভাবে দিয়েছে—রাষ্ট্রের আর্থিক শৃঙ্খলা ও সামাজিক ন্যায্যতা রক্ষার প্রশ্নে আপস করা হবে না। কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করে সরকার একদিকে যেমন সৎ করদাতাদের নৈতিক অবস্থানকে সম্মান জানিয়েছে, তেমনি দেশের অর্থনীতিকে একটি সুশাসনের পথে এগিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকারও পুনর্ব্যক্ত করেছে।
তবে বাজেট বাস্তবায়ন কতটা কার্যকর হবে, এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কতটা অর্জিত হবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কী ধরনের নীতি নেওয়া হবে—তা নির্ধারণ করবে এই বাজেটের সফলতা। এখন দেখার পালা—অন্তর্বর্তী সরকার তাদের আর্থিক নীতিতে কতটা কার্যকরতা দেখাতে পারে বাস্তবতায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ