
ছবি: সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত ভূরাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আবারও উত্তেজনার আগুন ছড়িয়ে দিল ইরান। দেশটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর সামরিক বাহিনী ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এবার সরাসরি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। এক কঠোর ভাষার বিবৃতিতে আইআরজিসি বলেছে, “অপরাধী আমেরিকান সরকার” অতীত থেকে শিক্ষা নেয়নি এবং ইরানের ভূখণ্ডে হামলা চালিয়ে এবার সেই ভুলের চরম মূল্য দিতে বাধ্য হবে।
সম্প্রতি ইরানের অভ্যন্তরে একটি বেসামরিক পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন হামলার খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশটির অভ্যন্তরে ক্ষোভ ও উত্তেজনা নতুন করে বেড়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দাবি করছে, তারা ইরানের সামরিক সংশ্লিষ্ট কিছু স্থাপনায় সীমিত ‘প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ’ নিয়েছে। তবে তেহরান এই বক্তব্যকে সরাসরি মিথ্যাচার ও উসকানিমূলক উল্লেখ করে তা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করেছে।
রবিবার (২২ জুন) রাতে প্রকাশিত এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে আইআরজিসি বলেছে, “অতীতের বোকামির পুনরাবৃত্তি যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অক্ষমতা এবং এই অঞ্চলের বাস্তবতার প্রতি তাদের নির্লজ্জ অবহেলারই প্রমাণ।”
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “পরমাণু শক্তিকে ঘিরে শান্তিপূর্ণ প্রকল্পগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি আগ্রাসন কেবলমাত্র একটি আঞ্চলিক সংকট নয়—এটি একটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা হুমকি এবং যুদ্ধোন্মাদ নীতির বহিঃপ্রকাশ। আমেরিকা এভাবে কার্যত নিজেকেই সামনের সারির আগ্রাসী শক্তি হিসেবে তুলে ধরেছে।”
আইআরজিসির বিবৃতির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অংশটি হলো, তারা জানিয়ে দিয়েছে—ইরানে হামলায় অংশ নেওয়া মার্কিন বিমানগুলো কোথা থেকে উড্ডয়ন করেছে, সেই ঘাঁটিগুলোর অবস্থান চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সেগুলোর ওপর নিরবচ্ছিন্ন নজরদারি চলছে।
আইআরজিসি বলেছে, “আমরা এখন পর্যন্ত যে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করেছি, তা আমাদের প্রতিক্রিয়ার মাত্রা ও পরিধি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটির সংখ্যা যত বেশি, তত বেশি দুর্বলতার কেন্দ্রবিন্দু সৃষ্টি হয়েছে।”
এই বক্তব্য দিয়ে তারা কার্যত যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়ে দিল যে, মার্কিন ঘাঁটিগুলো এখন আর সুরক্ষিত নয় বরং প্রতিশোধমূলক হামলার সরাসরি লক্ষ্যবস্তু।
ইরানের এই হুঁশিয়ারি এমন এক সময়ে এসেছে যখন মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উত্তেজনা চরমে। গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন, ইয়েমেনে সংঘাত, সিরিয়ায় বোমা হামলা ও লেবাননে হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলের সীমান্ত সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র বারবার মধ্যপ্রাচ্যে তার সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়ে চলেছে। কিন্তু ইরান মনে করছে, এই উপস্থিতি এখন আর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনো লাভ বয়ে আনছে না বরং আরও বড় বিপদের দ্বার উন্মুক্ত করছে।
আইআরজিসি একধাপ এগিয়ে বলেছে, “যুক্তরাষ্ট্রের এই অঞ্চলে সামরিক ঘাঁটি, তাদের সংখ্যাগত আধিক্য এবং প্রভাব—এই তিনটি উপাদান এখন তাদের জন্য একটি মারাত্মক দুর্বলতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলোর প্রত্যেকটি এখন নজরদারির আওতায় রয়েছে এবং আমরা প্রয়োজন হলে, জবাব দিতে এক মুহূর্ত দেরি করব না।”
আইআরজিসির এই হুঁশিয়ারির পরপরই ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দ্রুত রাশিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। আল জাজিরা জানায়, এই সফরের উদ্দেশ্য শুধু কূটনৈতিক বিনিময় নয়, বরং "জরুরি নিরাপত্তা মূল্যায়ন"—এমনটাই ইঙ্গিত মিলেছে তেহরানের ঘনিষ্ঠ সূত্র থেকে। পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে ইরান যুদ্ধ পরিস্থিতি, মার্কিন পদক্ষেপ, এবং প্রতিরক্ষামূলক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করতে পারে।
রাশিয়া-ইরান সাম্প্রতিক সময়ে যে ঘনিষ্ঠ সামরিক ও প্রযুক্তিগত জোট গড়ে তুলেছে, তা এখন পশ্চিমাদের জন্য বাড়তি উদ্বেগের কারণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই একতরফা সামরিক পদক্ষেপ ইরানকে রাশিয়ার আরও ঘনিষ্ঠ মিত্র বানাতে পারে, যা পুরো মধ্যপ্রাচ্যে শক্তির ভারসাম্যে বড় পরিবর্তন আনতে পারে।
তবে এখন পর্যন্ত জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা বড় কোনো আন্তর্জাতিক শক্তি এ বিষয়ে সরাসরি প্রতিক্রিয়া জানায়নি। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিস্থিতি যদি দ্রুত ঠান্ডা না হয়, তাহলে এটি একটি সরাসরি মার্কিন-ইরান সামরিক সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে। এর প্রভাব পড়বে উপসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনীতি, বৈশ্বিক তেল সরবরাহ এবং সারা বিশ্বের কূটনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর।
ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) যুক্তরাষ্ট্রকে যেভাবে সরাসরি ‘আক্রমণকারী শক্তি’ হিসেবে চিহ্নিত করে হুঁশিয়ারি দিয়েছে এবং মার্কিন ঘাঁটি নজরদারির কথা বলেছে, তা স্পষ্টতই বড় ধরনের যুদ্ধের পূর্বাভাস দিতে পারে। অতীতের মতো এবার যদি যুক্তরাষ্ট্র পরিস্থিতি গড়পড়তা কৌশলে সমাধান করতে চায়, তাহলে পরিণতি আরও ভয়াবহ হতে পারে—এমনটাই হুঁশিয়ারি দিচ্ছে ইরানের শীর্ষ সামরিক নেতৃত্ব।
এখন সবার নজর থাকবে তেহরান ও ওয়াশিংটনের পরবর্তী পদক্ষেপ, মস্কোয় ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের ফলাফল এবং মধ্যপ্রাচ্যে শক্তির ভারসাম্যে সম্ভাব্য পরিবর্তনের দিকে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ