
ছবি: সংগৃহীত
চলতি (জুন) মাসের প্রথম ১৮ দিনেই প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো আয় অর্থনীতিতে বড় রকমের চাঙ্গা ভাব নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, এই অল্প সময়েই প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে পাঠিয়েছেন ১ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২২ হাজার ৭০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ (প্রতি ডলার ১২২ টাকা ধরে)। প্রতিদিন গড়ে এই সময়টাতে এসেছে প্রায় ১০ কোটি ৩৩ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স।
এ প্রবাহ শুধু মাসিক পরিসংখ্যানেই নয়, বরং পুরো অর্থবছরের প্রেক্ষাপটেও একটি ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৪-২৫ সালের জুলাই থেকে জুনের ১৮ তারিখ পর্যন্ত মোট রেমিট্যান্স এসেছে ২৯ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ছিল ২৩ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ।
রেমিট্যান্স প্রবাহের এই ঊর্ধ্বমুখী ধারাটি নতুন নয়। সদ্যসমাপ্ত মে মাসেও দেশে এসেছে ২ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স। এর আগে চলতি বছরের মার্চ মাসে এসেছে সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার, যা একটি রেকর্ড।
এই ধারাবাহিকতা কেবল কয়েক মাসে সীমাবদ্ধ নয়, পুরো অর্থবছর জুড়েই ছিল প্রবৃদ্ধির ছাপ।
নিচে চলতি অর্থবছরের মাসভিত্তিক রেমিট্যান্সের পরিসংখ্যান তুলে ধরা হলো:
জুলাই: ১.৯১ বিলিয়ন ডলার
আগস্ট: ২.২২ বিলিয়ন ডলার
সেপ্টেম্বর: ২.৪০ বিলিয়ন ডলার
অক্টোবর: ২.৩৯ বিলিয়ন ডলার
নভেম্বর: ২.২০ বিলিয়ন ডলার
ডিসেম্বর: ২.৬৪ বিলিয়ন ডলার
জানুয়ারি: ২.১৯ বিলিয়ন ডলার
ফেব্রুয়ারি: ২.৫৩ বিলিয়ন ডলার
মার্চ: ৩.২৯ বিলিয়ন ডলার
এপ্রিল: ২.৭৫ বিলিয়ন ডলার
মে: ২.৯৭ বিলিয়ন ডলার
জুন (১৮ দিন): ১.৮৬ বিলিয়ন ডলার
এই হিসেবে দেখা যাচ্ছে, মাত্র ১১ মাস ১৮ দিনেই দেশের বৈধ রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলারের দ্বারপ্রান্তে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জুন মাস শেষ হওয়ার আগেই রেমিট্যান্স ৩১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা বাংলাদেশে রেমিট্যান্স ইতিহাসে সর্বোচ্চ হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের নানা ইতিবাচক নীতি উদ্যোগ এই প্রবাহ বৃদ্ধির প্রধান কারণ। বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলকে উৎসাহিত করতে
নগদ প্রণোদনা
মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসে রেমিট্যান্স প্রবেশে সহায়তা
হুন্ডি বা অবৈধ পথে অর্থ পাঠানো বন্ধে কড়াকড়ি
প্রবাসীদের জন্য ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সহজীকরণ
উৎসবকেন্দ্রিক রেমিট্যান্স সচেতনতা
এসব পদক্ষেপ ব্যাপক সুফল দিচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বিশেষ করে, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার মতো ধর্মীয় উৎসবের সময় প্রবাসী আয়ের গতি বাড়ে। এ বছর মার্চ ও মে মাসে রেকর্ড রেমিট্যান্স সেই বাস্তবতাকেই প্রমাণ করে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, ও ডলার ঘাটতির চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে রেমিট্যান্স প্রবাহ অর্থনীতিতে একটি বড় ‘লাইফলাইন’ হিসেবে কাজ করছে। রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সহায়তা ছাড়াও আমদানি ব্যয় মেটাতে এই রেমিট্যান্স বড় ভূমিকা রাখছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে চলতি অর্থবছরেই রিজার্ভ ৩০ বিলিয়নের কাছাকাছি যেতে পারে এবং টাকার ওপর চাপ কিছুটা হলেও কমবে।
অর্থনৈতিক পরিকল্পনাবিদরা মনে করছেন, শুধু রেমিট্যান্স বাড়ানো নয়, বরং তা নিয়মিত ও সুশৃঙ্খল রাখাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ। এজন্য প্রয়োজন—
অবকাঠামোগত বিনিয়োগ বাড়ানো
প্রবাসী শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়ন
অনিয়ম-দুর্নীতিমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা
রেমিট্যান্স ব্যবহারে নীতিগত স্বচ্ছতা
প্রবাসী আয় বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। চলতি অর্থবছরের এই উচ্চ রেমিট্যান্স প্রবাহ একদিকে যেমন অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখছে, অন্যদিকে ভবিষ্যতের জন্যও আস্থা জোগাচ্ছে। সরকারের সঠিক নীতিগত সমন্বয়, প্রবাসী সমাজের আস্থাশীলতা ও ব্যাংকিং সেবার আধুনিকায়ন যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে বাংলাদেশ শিগগিরই দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম রেমিট্যান্স নির্ভর অর্থনীতির মডেল হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ