
ছবি: সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্য যখন আবারও যুদ্ধের এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে, ঠিক সেই সময় ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি একটি কঠোর বার্তা দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনকে চমকে দিয়েছেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দিয়েছেন—ইহুদিবাদী ইসরাইল একটি ভয়াবহ ভুল করেছে, এবং তার ফল ভোগ করতেই হবে। এই শাস্তি শুধু শুরু হয়েছে, বরং তা চলতেই থাকবে।
রোববার রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) দেওয়া এক বিবৃতিতে আয়াতুল্লাহ খামেনি এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। পোস্টটিতে তিনি লেখেন, "ইহুদিবাদী শত্রু একটি বড় ভুল করেছে, একটি বড় অপরাধ করেছে; তাকে শাস্তি দিতে হবে এবং তাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে; এখনই তাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।" একই সঙ্গে ওই পোস্টে একটি জ্বলন্ত ভবনের পটভূমিতে ‘ডেভিডের তারকা’ চিহ্ন ধারণকারী একটি আগুনে পুড়তে থাকা খুলির ছবি যুক্ত ছিল, যা ছিল এক প্রতীকী ও স্পষ্ট বার্তা—ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের আগুন থামবে না।
এই হুঁশিয়ারি এমন এক সময়ে এসেছে, যখন গত ১৩ জুন ইসরাইল ইরানের ভেতরে অবস্থিত একটি গোপন পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। সূত্র জানায়, হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল তেহরানের উপকণ্ঠে অবস্থিত সামরিক স্থাপনাগুলো, যেগুলোতে পারমাণবিক গবেষণা কার্যক্রম চলছিল বলে দাবি করে ইসরাইল।
ইরান পাল্টা জবাবে সরাসরি তেলআবিবে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। এর পরপরই শুরু হয় ধাপে ধাপে সামরিক উত্তেজনার বিস্তার। হামলা-পাল্টা হামলায় গত কয়েক দিনে উভয় দেশেই বহু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। হাসপাতাল ও বেসামরিক স্থাপনায় ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ আসতে শুরু করেছে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে এটি একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের রূপ নিতে পারে।
ইসরাইল-ইরান সংঘাতের ধারাবাহিকতায় শনিবার (১৫ জুন) যুক্তরাষ্ট্রও সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন ঘোষণা দেয়, তারা ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালিয়েছে এবং সেই অভিযান ‘সম্পূর্ণ সফল’ ছিল।
ট্রাম্প নিজেই এক টেলিভিশন ভাষণে বলেন, “আমরা ফোরদো, নাতাঞ্জ এবং ইস্পাহান পারমাণবিক স্থাপনায় সফল হামলা চালিয়েছি। এই অভিযান ছিল প্রয়োজনীয়, সময়োপযোগী এবং ইরানকে একটি স্পষ্ট বার্তা দেওয়ার জন্য অপরিহার্য।”
উল্লেখ্য, ফোরদো ও নাতাঞ্জ হল ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র, যেখানে উচ্চমাত্রার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম চালানো হয়। অন্যদিকে ইস্পাহান পারমাণবিক প্রযুক্তি কেন্দ্রটিও অত্যন্ত কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
ইরান এই হামলার কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে। দেশটির পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (AEOI) মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলা শুধুমাত্র একটি আঞ্চলিক আগ্রাসন নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক আইন, বিশেষ করে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ সংক্রান্ত ‘নন-প্রলিফারেশন ট্রিটি’ (NPT) লঙ্ঘন করেছে। এই অপরাধের আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত।”
ইরানি বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সংঘাতে ইসরাইল এককভাবে হামলা চালায়নি, বরং যুক্তরাষ্ট্রের ছত্রছায়া ও সমর্থনেই এমন দুঃসাহস দেখিয়েছে। খামেনির মতে, পশ্চিমা বিশ্ব ইরানকে ‘দমন’ করতে চায়, কারণ তারা জানে, ফিলিস্তিন, লেবানন ও সিরিয়ার মতো স্থানে ইরান প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তুলেছে। বিশেষ করে গাজায় হামাস, দক্ষিণ লেবাননে হিজবুল্লাহ এবং ইরাকে ইরানঘনিষ্ঠ মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর সক্রিয় উপস্থিতি পশ্চিমাদের উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছে।
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, “এই হামলা আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যকে অগ্নিগর্ভ বানিয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে চাইছে। কিন্তু ইরান তা হতে দেবে না।”
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং রাশিয়া এ ঘটনার পরপরই উদ্বেগ প্রকাশ করে জানায়, পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা আন্তর্জাতিক চুক্তির চরম লঙ্ঘন এবং এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্য পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোও জানায়, এই যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে তা সিরিয়া, লেবানন ও ইয়েমেন হয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা এক ভয়াবহ সংঘাতে রূপ নেবে।
আয়াতুল্লাহ খামেনির ভাষ্য ও সামরিক প্রতিক্রিয়া ইঙ্গিত দিচ্ছে, ইরান এবার আর কূটনৈতিক বক্তব্যেই থেমে থাকবে না। বরং দেশটি সামরিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ব্যবহার করে প্রতিশোধের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে। ইসরাইলের পক্ষ থেকেও সেনাবাহিনীকে ‘পূর্ণ প্রস্তুত’ অবস্থায় রাখা হয়েছে বলে জানায় দেশটির প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF)।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মুহূর্তে ইসরাইল একদিকে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েছে, অন্যদিকে সামরিক ঝুঁকিও বেড়েছে। ট্রাম্পের সরাসরি যুক্ত হওয়া পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে।
এই সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও কূটনীতির এক নতুন মোড় সৃষ্টি করেছে। সৌদি আরব ও কাতার নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে আপাতত ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব লীগ এখন পর্যন্ত দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য আলাদা কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি।
বিশ্বব্যাপী তেলের দাম ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে, কারণ হরমুজ প্রণালীতে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ছে। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে তা শুধু পশ্চিম এশিয়া নয়, বরং বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
আয়াতুল্লাহ খামেনির হুঁশিয়ারি এবং যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইলের পারমাণবিক হামলার পাল্টা প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট করে দিচ্ছে—মধ্যপ্রাচ্য এখন এমন এক দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে গেছে, যেখানে কূটনৈতিক সমাধান অনেকটা দুরূহ হয়ে উঠছে। ইরান যদি সত্যিই “শাস্তির ধারা অব্যাহত” রাখে, তাহলে এই সংঘাত নিয়ন্ত্রণে রাখা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। সময়ই বলে দেবে, এই উত্তেজনার শেষ কোথায় গিয়ে থামে, কিংবা আদৌ থামে কি না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ