
ছবি: সংগৃহীত
জীবন—এ এক অদ্ভুত সফর। যে পথের শুরুটা আমাদের অজান্তেই, আর শেষটা অনিবার্য, অনুশাসনের মধ্যে বাঁধা। মানুষ একসময় ছিল না, সৃষ্টি করলেন মহান স্রষ্টা, আল্লাহ। তিনি মানুষকে পাঠিয়েছেন পরীক্ষার জন্য, এই পৃথিবীতে। এ দুনিয়া শান্তি ও দুঃখের এক মিশ্র প্রান্তর—না পুরোপুরি সুখের, না পুরোপুরি দুঃখের। জান্নাত যেমন পূর্ণ শান্তির আবাস, জাহান্নাম তেমনি চরম শাস্তির জায়গা। আর দুনিয়া—সুখ ও দুঃখের মিলনমঞ্চ।
এই মঞ্চে প্রতিটি মানুষকেই আল্লাহ দিয়ে থাকেন বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষা। কখনো তা আসে স্বাস্থ্যের বিপর্যয় হয়ে, কখনো জীবনের অপ্রাপ্তি হয়ে, আবার কখনো হয়ে ওঠে মানসিক, পারিবারিক কিংবা আর্থিক দুর্দশা। কেউ এই পরীক্ষায় অবিচল থাকে, কেউ ভেঙে পড়ে। অনেকে এমনও আছেন, যারা দুঃখ-কষ্টে অস্থির হয়ে আল্লাহর দরবারে ‘মৃত্যু’র প্রার্থনা করে বসেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো—মৃত্যু কামনা কি ইসলামসম্মত?
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন—“হে মুমিনগণ! ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।” (সূরা: বাকারা : ১৫৩)
এই আয়াতই প্রমাণ করে, কষ্ট ও দুঃখের সময় মুমিনের মূল হাতিয়ার হলো ধৈর্য। বিপদের মুখে ছুটে যাওয়া নয়, বরং মজবুত থাকা। হাদিসেও আমরা এই নির্দেশের ব্যাখ্যা পাই।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) দুনিয়াবী কষ্টে মৃত্যু কামনা করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।
সহিহ বুখারির (হাদিস: ৬৭৪১) বর্ণনায় আছে, আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন: “তোমাদের কেউ যেন কখনো মৃত্যু কামনা না করে। যদি সে সৎকর্মশীল হয়, তবে হয়তো আরো সৎকর্ম করবে। আর যদি সে পাপাচারী হয়, তবে হয়তো সে তাওবা করে নেবে।”
এই হাদিসে স্পষ্টভাবে বোঝানো হয়েছে, মৃত্যু কামনা করা মানে হলো জীবনের সুযোগকে বন্ধ করে দেওয়া। আল্লাহর পক্ষ থেকে নতুন করে কল্যাণের দরজা খুলে দেওয়ার যে সম্ভাবনা রয়েছে, সেটাকে নিজেই বন্ধ করে দেওয়া।
কষ্ট কখনো স্থায়ী নয়। জীবন চলতে থাকলে সময়ের পরিবর্তনে কষ্টের ঘনঘটা কেটে গিয়ে দেখা দেয় আশার আলো। একজন মুমিন জানে, দুনিয়াতে কোনো কষ্টই বিনা উদ্দেশ্যে আসে না। কষ্টে ধৈর্য ধারণ করলেই আল্লাহ দেন গুনাহ মাফের সুযোগ, মর্যাদার বৃদ্ধি এবং নৈকট্যের প্রতিদান।
শোকর যেমন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম, তেমনি সবর বা ধৈর্য হলো আল্লাহর সান্নিধ্য পাওয়ার এক মহাসোপান।
মুসলমানের জীবনের মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। আর সেই উদ্দেশ্যে পৌঁছাতে হলে চাই অবিচলতা, ধৈর্য ও আল্লাহর উপর ভরসা। দুনিয়ার দুঃখ যতই দীর্ঘ হোক না কেন, চূড়ান্ত পরিণতি জান্নাতের পথে গেলে সেটিই হবে চির শান্তির আবাস।
তাই মুমিন ব্যক্তি কখনো এভাবে চিন্তা করতে পারে না—‘মরেই যদি বাঁচা যায়!’ কারণ, দুনিয়ার এই সময়টুকুই তো মূলত পরীক্ষার সময়, যে সময়েই তার জান্নাতের টিকিট নিশ্চিত হতে পারে।
হ্যাঁ, ইসলাম কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে শর্তসাপেক্ষে মৃত্যুর দোয়া করার অনুমতি দিয়েছে। বিশেষ করে যদি কেউ এমন কঠিন দ্বীনি ফিতনা বা বিশ্বাসহানিকর পরিস্থিতিতে পড়ে যায়, যেখানে ঈমান রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
এ বিষয়ে সহিহ বুখারিতে (হাদিস: ৫২৬৯) বর্ণিত আছে, হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে, রাসূল (সা.) বলেছেন— “তোমাদের কেউ দুঃখ-দৈন্যে নিপতিত হয়ে যেন মৃত্যু কামনা না করে। যদি করতেই চায়, তাহলে যেন এই দোয়াটি করে: ‘হে আল্লাহ! আমাকে জীবিত রাখ, যতক্ষণ জীবিত থাকায় কল্যাণ রয়েছে; আর মৃত্যু দান কর, যখন মৃত্যুই আমার জন্য কল্যাণকর হয়।’”
এই দোয়াটি মুমিনের অন্তরজগতের অসহায়তা ও বিশ্বাসের গভীরতা একসঙ্গে প্রকাশ করে।
ঈমানদার মানুষের দায়িত্ব হলো দুঃখে, দারিদ্রে, ব্যর্থতায় অথবা শারীরিক-মানসিক যেকোনো কষ্টে আত্মসমর্পণ না করে, বরং নিজের ভরসা রাখে মহান রবের উপর। কষ্ট যত গভীরই হোক, তা নিঃসন্দেহে একদিন আল্লাহর রহমতে লাঘব হবে।
অনেকেই নিজের দুর্দশা দেখে দুনিয়াবি দিক থেকে ব্যর্থ মনে করে, অথচ আল্লাহর দৃষ্টিতে সে হয়তো সফলতার শীর্ষে—তার ধৈর্যের জন্য, তার ইবাদতের জন্য, তার ঈমান ধরে রাখার জন্য।
মৃত্যু কামনা কোনো সমাধান নয়, বরং তা একপ্রকার হতাশা ও ঈমানি দুর্বলতার লক্ষণ। ইসলাম চায়, একজন মুমিন সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর আস্থা রাখবে, ধৈর্য ধরবে এবং প্রত্যাশা করবে কল্যাণের। মৃত্যু নয়, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহর ইবাদতের সুযোগ কামনা করবে।
সফলতা নিশ্চিত তাদের জন্যই যারা দুর্দিনে ধৈর্য ধরে, আল্লাহর কাছেই সাহায্য চায়, এবং জানে—আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গেই থাকেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ