
ছবি: সংগৃহীত
দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে নাটকীয়তা আরও এক ধাপ বেড়ে গেলো সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে। রোববার রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে। এই গ্রেফতার এমন এক সময়ে ঘটলো, যখন এর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে আরেক সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ কে এম নুরুল হুদাকে রাজধানীর উত্তরা থেকে জনতার সহায়তায় গ্রেফতার করে পুলিশ। রাজনৈতিক অঙ্গনে এই দুজনের পরপর গ্রেফতারে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র হাবিবুল আউয়ালের গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। সূত্রটি জানায়, রোববার রাত সাড়ে ৯টার দিকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসা থেকে তাঁকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। তবে গ্রেফতারে কোন বাহিনী অংশ নিয়েছে—তা নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মো. নাসিরুল ইসলাম বলেন, “ডিবির পক্ষ থেকে বসুন্ধরায় কোনো অভিযান পরিচালনা করা হয়নি।”
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রপতির নিয়োগে কাজী হাবিবুল আউয়াল প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকেই ব্যাপক বিতর্ক দেখা দেয়। নির্বাচন কমিশনের অধীনেই আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী এবং একই দলের ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থীদের মধ্যকার একতরফা প্রতিযোগিতায় ব্যাপক অভিযোগ ওঠে যে, সাধারণ ভোটাররা ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতই হননি, অথচ ঘোষিত ভোটের হার ছিল অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
ভোটের দিন দুপুর ৩টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণের হার ২৭ দশমিক ১৫ শতাংশ বলে জানানো হয় কমিশনের পক্ষ থেকে। কিন্তু মাত্র এক ঘণ্টার ব্যবধানে হঠাৎ ভোটের হার বেড়ে ৪০ শতাংশ বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। এমন বিপরীতমুখী তথ্যের ব্যাখ্যা চেয়ে গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে চাপ সৃষ্টি হলে হাবিবুল আউয়াল নিজেই স্বীকার করেন, “প্রথমে ২৮ শতাংশ বলা হয়েছিল, পরে ৪০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে।” এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই “আমি-ডামি ভোট” নামে ব্যঙ্গাত্মক শিরোনাম পায় তার কমিশন।
ওই বিতর্কিত নির্বাচনের পর বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দল সরাসরি নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। মামলায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল ছাড়াও সাবেক সিইসি এ কে এম নুরুল হুদা এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মামলার অভিযোগে বলা হয়, তারা “রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অপব্যবহার করে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেছেন, এবং নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছেন।”
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই হাবিবুল আউয়াল আত্মগোপনে চলে যান। দীর্ঘ সময় তিনি কোনো গণমাধ্যম বা জনসমক্ষে দেখা দেননি। ধারণা করা হচ্ছিল, তিনি হয়তো বিদেশে অবস্থান করছেন। তবে শেষ পর্যন্ত জানা যায়, তিনি রাজধানীর অভিজাত বসুন্ধরা এলাকায় গোপনে বসবাস করছিলেন।
রোববার রাতেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হঠাৎ অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে। এই গ্রেফতার নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা তুঙ্গে উঠেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, “এই গ্রেফতার অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল, কারণ তিনি গণতন্ত্রকে প্রহসনে পরিণত করেছিলেন।”
এর আগে, রোববার সন্ধ্যায় উত্তরা থেকে স্থানীয় জনতার সহায়তায় গ্রেফতার হন সাবেক সিইসি এ কে এম নুরুল হুদা। জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে থাকলেও ওইদিন হঠাৎ স্থানীয় এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেন তিনি। খবর পেয়ে এলাকাবাসী তাকে চিহ্নিত করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এই দুই সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারের একই দিনে গ্রেফতার অনেকের কাছে অবাক করার মতো ঘটনা হলেও, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, “জনগণের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও বিচার দাবির ফল হিসেবেই এটা দেখা যেতে পারে।”
হাবিবুল আউয়াল কমিশন বরাবরই নির্বাচনকে ‘স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক’ দাবি করলেও বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এই নির্বাচন বর্জন করেছিল, ভোটারদের উপস্থিতিও ছিল রেকর্ড পরিমাণ কম। অথচ নির্বাচন কমিশন দাবি করে, অংশগ্রহণকারী দলগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন ছিল ‘প্রতিযোগিতাপূর্ণ’।
সামগ্রিকভাবে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন নানা বিতর্ক, ব্যর্থতা ও অনৈতিকতার দায়ে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিল। আর সেই সব অভিযোগেরই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে তার এই গ্রেফতারে।
হাবিবুল আউয়ালের বিরুদ্ধে কোন মামলায়, কোন ধারায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে—তা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি পুলিশ। তবে ধারণা করা হচ্ছে, রাষ্ট্রদ্রোহ, ভোট জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার সংক্রান্ত একাধিক মামলায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্তের আওতায় নেওয়া হতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই গ্রেফতার শুধু একজন কর্মকর্তার নয়, বরং পুরো নির্বাচন ব্যবস্থার ন্যায্যতা, নিরপেক্ষতা ও দায়বদ্ধতার প্রশ্নে একটি যুগান্তকারী অধ্যায় হতে পারে। এখন দেখার বিষয়, হাবিবুল আউয়ালের গ্রেফতারের পরে অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার কিংবা রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধেও আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয় কিনা।
এই গ্রেফতার বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্কে একটি নতুন মাত্রা যোগ করল। জনগণ এখন বিচার চায়—কেবল একজন কমিশনারের নয়, পুরো এক যুগের প্রহসনের।
বাংলাবার্তা/এমএইচ