
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমানকে অপসারণের দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে রাজস্ব প্রশাসন। ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যেই এবার আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘লাগাতার কমপ্লিট শাটডাউনের’ ঘোষণা দিয়েছেন। আগামী শনিবার (২৮ জুন) থেকে কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগের সব দপ্তরে কার্যত অচলাবস্থার সূচনা হতে পারে বলে জানানো হয়েছে।
সোমবার (২৩ জুন) দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআর কার্যালয়ের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার ও মহাসচিব সেহেলা সিদ্দিকা। এই প্ল্যাটফর্মটি এনবিআরের অভ্যন্তরীণ সংস্কার এবং কর্মকর্তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
কাফনের কাপড় পরে প্রতিবাদ, শাসক আমলাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ
সোমবার ঘোষিত নতুন কর্মসূচির অংশ হিসেবে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত কলম বিরতি পালন করেন এনবিআরের সহস্রাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী। অনেককে এ সময় প্রতিবাদসূচকভাবে কাফনের কাপড় পরতে দেখা যায়। কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীরা দাবি করেন, এনবিআর চেয়ারম্যান সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছেন এবং রাজস্ব প্রশাসনের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা করছেন।
তারা আরও বলেন, “চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান রাজস্ব প্রশাসনের সুশৃঙ্খল কাঠামোকে ভেঙে দিতে পরিকল্পিতভাবে বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের বদলি, নিপীড়ন এবং হুমকি দিচ্ছেন। এটি শুধুমাত্র আমাদের অধিকার হরণই নয়, রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাকেও হুমকির মুখে ফেলেছে।”
বদলি আদেশে নতুন আগুন, কর্মকর্তারা বলছেন ‘প্রতিহিংসা’
এই প্রতিবাদের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে সম্প্রতি জারিকৃত কয়েকটি বদলি আদেশ। রোববার এনবিআরের আয়কর অনুবিভাগের পাঁচজন কর্মকর্তাকে ‘তাৎক্ষণিক’ বদলি করা হয়। এসব কর্মকর্তার মধ্যে রয়েছেন—শাহ মোহাম্মদ ফজলে এলাহী (আয়কর গোয়েন্দা থেকে ময়মনসিংহ কর অঞ্চল), মোহাম্মদ শিহাবুল ইসলাম (ঢাকার কর অঞ্চল-১৬ থেকে খুলনায়), মো. আব্দুল্লাহ ইউসুফ (বোর্ড থেকে বগুড়ায়), ইমাম তৌহিদ হাসান শাকিল (আয়কর গোয়েন্দা থেকে কুমিল্লায়), এবং নুসরাত জাহান শমী (কুমিল্লা থেকে রংপুরে)।
এ বদলিকে ‘নিষ্ঠুর প্রতিহিংসা’ উল্লেখ করে ঐক্য পরিষদের নেতারা বলেন, “সরকারি চাকরি বিধি ও বদলি নীতিমালাকে উপেক্ষা করে অপছন্দের কর্মকর্তাদের হেনস্তা করা হচ্ছে। এতে পরিষ্কার যে, এনবিআর চেয়ারম্যান ক্ষমতার অপব্যবহারে লিপ্ত হয়েছেন এবং একটি কু-সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন।”
কর্মসূচির ঘোষণা: ধাপে ধাপে অচলাবস্থা, শেষ ধাপে শাটডাউন
সংবাদ সম্মেলনে ঐক্য পরিষদ তাদের পরবর্তী আন্দোলনের রূপরেখা ঘোষণা করে জানায়: মঙ্গলবার (২৫ জুন): ঢাকার কর, কাস্টমস ও ভ্যাট অফিসে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি ও কলম বিরতি। ঢাকার বাইরে বিভাগীয় অফিসগুলোতে একইভাবে কর্মসূচি পালিত হবে। এ সময় “চেয়ারম্যান ও তার দোসরদের প্রতি ঘৃণা” প্রকাশ চলবে।
বুধবার ও বৃহস্পতিবার (২৬-২৭ জুন): দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা ও রপ্তানি ব্যতীত সব দপ্তরে কর্মবিরতি, অবস্থান কর্মসূচি এবং প্রতীকী প্রতিবাদ চলবে।
শনিবার (২৮ জুন) থেকে: যদি এর মধ্যে বদলি আদেশ প্রত্যাহার এবং চেয়ারম্যান অপসারণ না করা হয়, তাহলে কাস্টমস, ভ্যাট ও কর বিভাগের সব দপ্তরে ‘লাগাতার কমপ্লিট শাটডাউন’ শুরু হবে।
এনবিআর চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ‘ভয়াবহ’ অভিযোগ
সংগঠনের লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, “চেয়ারম্যান শুধু বদলি-নিপীড়নের মাধ্যমে আতঙ্ক সৃষ্টি করছেন না, বরং স্পর্শকাতর কর কমিশনার পদে প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছেন, যা স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার পরিপন্থী। তিনি একটি বিশেষ মহলের হয়ে কাজ করছেন, যা রাজস্ব প্রশাসনের নিরপেক্ষতা ধ্বংস করে দিচ্ছে।”
সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, “চেয়ারম্যান তার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাইরে থেকে লোক এনে আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে চাইছেন। এমন উসকানিমূলক তৎপরতার যথেষ্ট প্রমাণ আমাদের হাতে রয়েছে।”
আন্দোলনের পেছনের পটভূমি
এ বছরের মে মাসে এনবিআরকে দুটি ভাগে ভাগ করে ‘রাজস্ব নীতি’ এবং ‘রাজস্ব প্রশাসন’ নামে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ গঠন করে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এই অধ্যাদেশকে এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন এবং কর্মবিরতি, অবস্থান কর্মসূচি, কালো ব্যাজ ধারণসহ নানা প্রতিবাদে অংশ নেন।
তীব্র আন্দোলনের মুখে সরকার অধ্যাদেশ বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত স্থগিত রেখে আলোচনার আশ্বাস দেয়। এরপর আন্দোলনকারীরা সীমিত আকারে কাজে যোগ দেন। কিন্তু চেয়ারম্যানকে অপসারণের দাবিতে তারা দৃঢ় থাকেন এবং তাকে এনবিআর কার্যালয়ে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেন।
পরে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া পাহারায় চেয়ারম্যান কার্যালয়ে প্রবেশ করেন। তবে তার সঙ্গে আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দূরত্ব বরাবরই রয়ে গেছে।
রাজস্ব সংগ্রহে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা
এ আন্দোলনের ফলে কর, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগে দীর্ঘমেয়াদি অচলাবস্থার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “দপ্তরগুলোতে দাফতরিক কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। নিয়মিত রাজস্ব সংক্রান্ত কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যার প্রভাব জাতীয় রাজস্ব আহরণে পড়তে বাধ্য।”
সরকার ও এনবিআর এখন কী করবে?
এনবিআর চেয়ারম্যান ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত এ দাবির প্রেক্ষিতে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, “এই মুহূর্তে সরকার যদি গঠনমূলক সংলাপের পথে না হাঁটে এবং পরিস্থিতিকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে, তাহলে তা রাজস্ব প্রশাসনের স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।”
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের দাবি অনুযায়ী, আন্দোলন এখন কেবল বদলি বা একটি অধ্যাদেশের বিরোধিতা নয়—এটি রূপ নিয়েছে একটি নীতিগত এবং প্রশাসনিক সংগ্রামে, যেখানে কর্মকর্তারা নিজেদের সম্মান, অধিকার এবং পেশাগত স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন।
সবার চোখ এখন আগামী শনিবারের দিকে—চেয়ারম্যান থাকছেন না কি রাজস্ব প্রশাসনের কার্যক্রমই থমকে যাচ্ছে, তা নির্ধারিত হবে এই সময়ের মধ্যে সরকারের পদক্ষেপে।
বাংলাবার্তা/এসজে