
ছবি: সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে বাংলাদেশের জন্য অনুমোদিত ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্যাকেজের আওতায় চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড়ের বিষয়টি আজ (বাংলাদেশ সময় সোমবার রাতে) ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিতব্য সংস্থাটির নির্বাহী বোর্ড সভায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এই দুই কিস্তির মোট অর্থের পরিমাণ ১৩০ কোটি ডলার বা প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে উল্লেখযোগ্য সহায়তা প্রদান করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আইএমএফের সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত, যেখানে বাংলাদেশ সময় অনুযায়ী রাতেই এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এই সভায় বাংলাদেশের প্রস্তাব অনুমোদিত হলে পরবর্তী কয়েক কর্মদিবসের মধ্যেই অর্থ ছাড় হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অ্যাকাউন্টে জমা পড়বে এবং সরকার এই অর্থ সরাসরি পেয়ে যাবে।
এর ফলে দেশের রিজার্ভ পরিস্থিতিতে খানিকটা স্বস্তি ফিরে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৯ বিলিয়ন ডলারের আশেপাশে অবস্থান করছে (ব্রুটো হিসাবে), যা প্রয়োজনের তুলনায় বেশ চাপের মধ্যেই রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অর্থ ছাড় দেশের আমদানি ব্যয় মেটাতে এবং রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় কিছুটা স্থিতিশীলতা আনবে।
২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে আইএমএফের চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের বিষয়টি ঝুলে ছিল। প্রধান কারণ ছিল—আইএমএফের শর্ত পূরণে সরকারের ধীর গতি এবং কিছু ক্ষেত্রে অনীহা। সংস্থাটি স্পষ্টভাবে বলেছিল, তারা কিস্তির অর্থ ছাড় করবে না, যতক্ষণ না বাংলাদেশ আর্থিক খাত, রাজস্ব সংগ্রহ, ভর্তুকি হ্রাস এবং বৈদেশিক মুদ্রাবাজার সংস্কারসহ প্রতিশ্রুত মূল শর্তগুলো বাস্তবায়ন করতে না পারে।
দীর্ঘ দরকষাকষি এবং একাধিকবার আইএমএফ মিশনের ঢাকা সফরের পর চলতি বছরের মে মাসে উভয় পক্ষ একটি আপসযোগ্য সমঝোতায় পৌঁছায়। সেই অনুযায়ী আইএমএফ এখন চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ একত্রে ছাড় করতে যাচ্ছে। এর আগে বাংলাদেশ এই ঋণ কর্মসূচির আওতায় প্রথম তিন কিস্তিতে মোট ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে।
আইএমএফের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্ত ছিল—ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব ব্যাংকসমূহের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। যদিও এতে বাজারে ডলারের দাম কিছুটা বেড়েছে, তবে অতীতের চেয়ে বিনিময় হার এখন তুলনামূলক স্থিতিশীল।
রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু সংস্কার আনা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) একাধিক পর্যায়ে নতুন পদ সৃষ্টি ও কর্মকর্তাদের রদবদল করে ঢেলে সাজানো হয়েছে। কর নীতিতে স্বচ্ছতা ও ডিজিটালাইজেশন জোরদার করা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে রাজস্ব আদায়ে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছে সরকার।
এ ছাড়া, সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর প্রক্রিয়াও কিছুটা এগিয়েছে। তবে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির উচ্চ চাপ বিবেচনায় বিদ্যুতের দাম আপাতত বাড়ানো হচ্ছে না—এ ঘোষণা অর্থ উপদেষ্টা সাম্প্রতিক বাজেট বক্তৃতায় দিয়েছেন। সরকারের দাবি, ভর্তুকি কমানোর এই সিদ্ধান্তগুলো ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে যাতে জনজীবনে অতিরিক্ত চাপ না পড়ে।
আইএমএফের আরেকটি বড় শর্ত ছিল মূল্যস্ফীতি সহনীয় না হওয়া পর্যন্ত কঠোর মুদ্রানীতি অনুসরণ করা। এর অর্থ হলো—ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়ে টাকা সরবরাহ সীমিত রাখা, যাতে ভোগব্যয় হ্রাস পায় এবং মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার নীতিগত সুদের হার বাড়িয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর সম্প্রতি জানিয়েছেন, মূল্যস্ফীতির হার সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে, এবং তখন সুদের হারও ধীরে ধীরে কমানোর সুযোগ সৃষ্টি হবে।
২০২২ সালে বৈশ্বিক মহামন্দার অভিঘাতে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক ধাক্কায় কমে আসে। একই সঙ্গে ডলার সংকট, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং রপ্তানি আয়ে স্থবিরতা তৈরি হয়। এই সংকট মোকাবেলায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাচ্যুত সরকার আইএমএফের দ্বারস্থ হয়। দীর্ঘ আলোচনার পর ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে। এই ঋণ ৪২ মাস মেয়াদি, যার মধ্যে নির্দিষ্ট সময় অন্তর কিস্তিভিত্তিক অর্থ ছাড়ের কথা রয়েছে। এই অর্থের সঙ্গে বড় ধরনের নীতিগত সংস্কারও যুক্ত করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে আইএমএফ।
আজকের বৈঠকে অনুমোদন পাওয়া গেলে, আগামী ৫ কার্যদিবসের মধ্যেই ১৩০ কোটি ডলারের এই কিস্তি বাংলাদেশ পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটি বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় বড় ধরনের একটি স্বস্তি দেবে—বিশেষ করে যেখানে রিজার্ভ, ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতি ও বিনিয়োগ স্থবিরতা ঘিরে জনমনে অনিশ্চয়তা বাড়ছে।
সরকার আশাবাদী, এই ঋণ শুধু রিজার্ভ শক্তিশালী করবেই না, বরং দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংস্কারের অনুঘটক হিসেবেও কাজ করবে। তবে বাস্তবায়নেই যে আসল চ্যালেঞ্জ—তা আবারও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এই এক বছরের দেরিতে কিস্তি ছাড়ের অভিজ্ঞতা থেকে। এখন দেখার বিষয়, কতটা ধারাবাহিকভাবে সরকার বাকি শর্তগুলো পূরণ করতে পারে, যাতে করে আগামী কিস্তিগুলো সময়মতো ছাড় হয় এবং দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ