
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় নির্বাচনের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় অংশ নেওয়া প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যতই সংলাপ এগোচ্ছে, ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে—সংবিধান, সংস্কার ও রাষ্ট্র কাঠামো পুনর্গঠন নিয়ে মতপার্থক্য এবং আস্থার সংকট। লন্ডনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিএনপি ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল, আপাতদৃষ্টিতে তা কিছুটা নিরসন হয়েছে। কিন্তু তারই ফাঁকে ভিন্নমাত্রা নিচ্ছে মূল রাজনৈতিক বিবাদ—বিশেষ করে, কোন সংস্কার কবে ও কীভাবে বাস্তবায়িত হবে এবং এই সংস্কার কতটা মৌলিক হবে, তা নিয়ে।
জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তুলতে গিয়ে প্রধান তিনটি রাজনৈতিক শক্তি—বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)—ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নিচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, দলীয় সরকারের বিকল্প ব্যবস্থা, কিংবা নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো নিয়ে অনেকটাই একমত হওয়া গেলেও বেশ কিছু মৌলিক বিষয়ে মতভেদ থেকে যাচ্ছে।
এর মধ্যে রয়েছে—একজন ব্যক্তি কতবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, একই সঙ্গে দলীয় প্রধান ও সরকার প্রধানের পদে থাকা যাবে কিনা, রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতি, সংবিধানের মূলনীতির ব্যাখ্যা, এমনকি সংবিধানটি থাকবে কি থাকবে না—এইসব বিষয়ে অবস্থানগুলো তীব্রভাবে ভিন্ন।
বিএনপি যেমন বলছে, একজন ব্যক্তি দুইবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, এমন কঠোর বিধান না থাকলেও নির্দিষ্ট ব্যবধানে (গ্যাপ দিয়ে) তৃতীয়বার সুযোগ থাকা উচিত। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “গ্যাপ দিয়ে যদি এমন পরিস্থিতি আসে যেখানে জনগণের চাওয়া রয়েছে, তখন তৃতীয়বার হওয়াটা গণতন্ত্রের পরিপন্থী নয়।”
এছাড়া দলীয় প্রধান ও সরকার প্রধান একই ব্যক্তি হলে সমস্যার কিছু নেই বলেও দাবি করেন বিএনপি নেতারা। কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে দ্বিমত পোষণ করছে জামায়াত ও এনসিপি। জামায়াতে ইসলামির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, “একজন ব্যক্তি দীর্ঘদিন প্রধানমন্ত্রী থাকলে, অথবা একসঙ্গে দল ও সরকার চালালে আবার কর্তৃত্ববাদী শাসন ফিরে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়। এটা সেই আন্দোলনের স্পিরিটের বিরোধী—যেটার জন্য এই দেশে রক্ত ঝরেছে।”
সংবিধান বা রাষ্ট্র কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়ন কখন হবে—এই প্রশ্নে এনসিপি ও জামায়াত একরকম হলেও বিএনপির অবস্থান অপেক্ষাকৃত নরম। জামায়াত এবং এনসিপি বলছে, নির্বাচন হওয়ার আগে সংস্কারগুলো কার্যকর না হলে, নির্বাচনের পর সেই সংস্কার বাস্তবায়ন ঝুলে পড়তে পারে। এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসাইন বলেন, “অধ্যাদেশ জারি করেও সংস্কার কার্যকর করা সম্ভব। মূল কথা হলো—নির্বাচনের আগে দৃশ্যমান পরিবর্তন দরকার।”
অন্যদিকে বিএনপি বলছে, যেসব সংস্কারে সর্বসম্মতি আসবে, সেগুলোই জুলাই সনদে স্থান পাবে। যেগুলো নিয়ে দ্বিমত থাকবে, সেগুলো নির্বাচনের পরে জনগণের রায়ের ভিত্তিতে বাস্তবায়িত হতে পারে। আমীর খসরু বলেন, “সব বিষয়ে সবাই একমত হবে না। তাই যেগুলো নিয়ে ঐকমত্য আসবে, সেগুলো নিয়ে আগানো হোক। বাকিগুলো নিয়ে জনগণের ম্যান্ডেট নেওয়া যাক।”
কিন্তু এই অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এনসিপি। আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, “শুধু সাধারণ কিছু বিষয়ে ঐকমত্য গঠিত হলে তাতে শাসন ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন আসবে না। সেটা আমরা মৌলিক সংস্কার বলে মানি না।”
আরেকটি বিতর্ক ঘনীভূত হচ্ছে সংবিধানকে ঘিরে। বিএনপি এবং জামায়াত যেখানে সংবিধান সংশোধনের পক্ষপাতী, এনসিপি সেখানে একটি পুরোপুরি নতুন সংবিধানের প্রস্তাব দিয়েছে। এনসিপি বলছে, শুধু সংশোধনের মাধ্যমে মৌলিক পরিবর্তন স্থায়ী হবে না। অতীতে দেখা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে, আবার মূলনীতিগুলোও পরিবর্তিত হয়েছে, যেগুলো আদালতে চ্যালেঞ্জ করে বাতিল করা সম্ভব হয়েছে।
আখতার হোসাইনের ভাষায়, “ঘষামাজা সংস্কার করলে ভবিষ্যতে আবার ক্ষমতায় এসে কেউ সেগুলো বাতিল করে দিতে পারে। ফলে মৌলিক পরিবর্তনের জন্য নতুন সংবিধান প্রয়োজন।”
ঐকমত্য গঠনের এই জটিল পরিস্থিতিতে জামায়াতে ইসলামি বলছে, যেসব ইস্যুতে একমত হওয়া যাচ্ছে না, সেগুলো গণভোটে দিয়ে সমাধান খোঁজা উচিত। হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, “মৌলিক ইস্যু তো ফেলে রাখা যাবে না। এগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। এসব নিয়ে দেশের জনগণের রায় নেওয়া দরকার। গণভোটের মাধ্যমেই সেটেল করা হোক। জনগণ যেটিকে সমর্থন করবে, সেটাই হোক জুলাই সনদ।”
অন্যদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলছেন, এখনো কমিশনের প্রধান লক্ষ্য হলো—যতটা সম্ভব মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য গঠন করা। তিনি বলেন, “আমরা কাউকে বাধ্য করতে পারবো না। কিন্তু আমরা আশা করছি, দলগুলো কিছু ছাড় দিয়ে হলেও জবাবদিহিমূলক এবং বিকেন্দ্রীকৃত রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে একমত হবে।”
যদিও রাজনৈতিক দলগুলো একশত ছেষট্টিটি বিষয়ের আলোকে নিয়মিত বৈঠকে বসছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই মতৈক্যে পৌঁছেছে, তবু কিছু মৌলিক ইস্যুতে যে বিভক্তি রয়ে গেছে, তা অগ্রগতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।
বিশেষ করে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়েও নতুন করে সংশয় তৈরি হয়েছে। প্রথমে যেখানে এই প্রশ্নটি তুলেছিল বিএনপি, এখন সেখানে জামায়াতসহ আরও কয়েকটি দলও এই প্রশ্ন তুলছে। ফলে নির্বাচন ঘিরে জাতীয় ঐকমত্যের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে দলগুলোর রাজনৈতিক সদিচ্ছা, ছাড় দেওয়ার মানসিকতা এবং জনগণের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আচরণের ওপর।
এই অবস্থায় কমিশনের ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ শুধু কাগজে ঐকমত্য গঠনের নয়, বরং বাস্তবায়নের বাস্তবিকতা, সময়সীমা এবং গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করার দিকেও। নইলে রাজনৈতিক ঐক্যের নামে কেবল অগ্রহণযোগ্য একটি আপসচিত্র সৃষ্টি হবে, যা দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে আরও গভীর সংকট ডেকে আনতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ