
ছবি: সংগৃহীত
সরকার এখনো মাদক ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণভাবে সফল নয়, এমন অকপট স্বীকারোক্তি এসেছে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর কাছ থেকে।
২৬ জুন ‘মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস’ উপলক্ষে বুধবার সচিবালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “মাদক ও দুর্নীতি—এই দুইটি এখনো আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। সরকার অনেক চেষ্টা করছে, কিন্তু বাস্তবতা হলো এই দুইটি ক্ষেত্রেই আমরা এখনো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি।”
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “ভারতের লোকজন ফেনসিডিল খায় না। ওরা তৈরি করে শুধুমাত্র বাংলাদেশে পাচারের জন্য। আমরা এটা ঠেকাতে চাই, কিন্তু পুরোপুরি পারছি না।”
তিনি অভিযোগ করেন, “দেশে মাদক প্রবেশ বন্ধ করতে হলে শুধু অভ্যন্তরীণ অভিযান নয়, সীমান্ত ও আন্তর্জাতিক স্তরেও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।”
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পরিষ্কারভাবে বলেন, “মাদক ব্যবসায় যেসব গডফাদার আছে তারা আমাদের সাথেই ঘোরে, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বসে চা খায়, সেলফি তোলে—এদের ধরার উদ্যোগ না নিলে বহনকারীদের ধরে লাভ নেই। এই মাদককারবারিরা সমাজের মূলধারায় মিশে গেছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে ক্লোজড করেছি। তার বিরুদ্ধে মাদক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই সে কাশিমপুর কিংবা কেরানীগঞ্জে ঢুকে যাবে।”
তিনি বলেন, “শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একার পক্ষে এই ভয়ঙ্কর মাদকের বিস্তার বন্ধ করা সম্ভব নয়। আমাদের সমাজের সব শ্রেণিকে মাদকের ক্ষতিকর দিকগুলো বুঝতে হবে।”
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশে বিভিন্ন মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন এনজিও, সংস্থা ও ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা ৩২টি বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্রকে সরকারি অনুদান দেওয়া হয়েছে। তবে নিরাময় কেন্দ্র করেই মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। আমাদের সিস্টেম চেইন কেটে ফেলতে হবে, শিকড় উপড়ে ফেলতে হবে।”
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সরাসরি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, “আমরা শুধু বহনকারীদের ধরতে পারি, কিন্তু গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। এভাবে মাদক বন্ধ হবে না। আপনাদের হাতিয়ার দেওয়া হয়েছে—প্রকল্প, বাজেট, লোকবল—সবই আছে। এখন দায়িত্ব আপনাদের।”
তিনি বলেন, “গডফাদার ধরলে, মূল সিন্ডিকেট ধরা পড়লে, পুরো নেটওয়ার্ক একবারে ভেঙে পড়বে। শুধুমাত্র নিচের স্তরের লোকদের ধরে লাভ নেই। প্রতিটি পর্যায়ে একটা পরিবর্তন আনতে হবে।”
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও এক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়ে বলেন, “আমাদের আশেপাশের একটা বাহিনী পুরোপুরি ইয়াবার ওপর নির্ভরশীল। এই মাদক ব্যবসা থেকেই তারা আয় করে সংসার চালাচ্ছে, অস্ত্র কিনছে। আমরা এই বাহিনীর নাম বলছি না, কিন্তু বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক।”
তিনি স্বীকার করেন, “আমরা এখনো পুরোপুরি সফল হতে পারিনি। তবে চেষ্টা করছি। বদি নামটা আপনারা জানেন। এখন অনেক বদি হয়ে গেছে—ছদ্মবেশে, প্রভাব খাটিয়ে তারা নিজেদের রক্ষা করছে। এই প্রতিরোধ যুদ্ধ সহজ হবে না, তবে আমরা লড়ছি।”
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “অনেকে বলে মাদক নিয়ন্ত্রণে এসেছে, কিন্তু আমি এমন দাবি করিনি। পরিসংখ্যান দিয়ে বাস্তবতা ঢেকে রাখা যায় না। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ইয়াবা, ফেনসিডিল, আইসসহ কাউকে ধরা পড়তে দেখা যায়।
সুতরাং বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে, গা বাঁচানোর রাজনীতি না করে—মাদকের বিরুদ্ধে সত্যিকারের যুদ্ধ শুরু করতে হবে। না হলে আমাদের তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।”
অনুষ্ঠান শেষে ৩২টি বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের প্রতিনিধিদের মধ্যে অর্থনৈতিক অনুদানের চেক বিতরণ করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। এ সময় তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. খোদা বখস চৌধুরী এবং সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি।
মাদক ও দুর্নীতি—দুই ভয়াবহ শত্রু একযোগে গ্রাস করছে দেশের ভবিষ্যৎ। যেকোনো শক্তিশালী প্রশাসনের জন্য এটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে সরকারের এই খোলামেলা স্বীকারোক্তি এবং গডফাদার ধরার অঙ্গীকার—যদি তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়—তবে এক নতুন মোড় নিতে পারে বাংলাদেশের মাদকবিরোধী যুদ্ধ। এখন সময় কথায় নয়, কাজে দেখানোর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ