
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় সংসদের আসনসংখ্যা অপরিবর্তিত থাকলেও নির্বাচনের আগে নতুনভাবে আসন সীমানা পুনর্বিন্যাসকে ঘিরে নির্বাচন কমিশনে জমতে শুরু করেছে রাজনৈতিক তৎপরতা। এখনো নির্বাচন কমিশন (ইসি) সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসের খসড়া তালিকা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি, তবে এর আগেই শুরু হয়েছে সংশ্লিষ্টদের জোরালো অবস্থান গ্রহণ ও লবিং।
বিশেষ করে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা সক্রিয়ভাবে কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন, নিজ নিজ এলাকার পুরাতন আসন গঠন বা পূর্ববর্তী সীমানা ফিরিয়ে আনার দাবিতে।
বুধবার (২৫ জুন) ঢাকার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন ভবনে সিইসি এএমএম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে পৃথকভাবে দেখা করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, কেন্দ্রীয় নেতাসহ জেলা পর্যায়ের একাধিক প্রভাবশালী নেতা। এর মধ্যে অন্তত দুই দফা বৈঠক হয় বিএনপিপন্থি নেতাদের সঙ্গে, যদিও তারা এটিকে আনুষ্ঠানিক দলীয় বৈঠক নয়, ব্যক্তি বা নির্বাচনি এলাকার স্বার্থে সৌজন্য সাক্ষাৎ বলে দাবি করেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মনিরুল হক চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক (কুমিল্লা বিভাগ) অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু, যুগ্ম মহাসচিব আব্দুস সালাম আজাদ, মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপি সভাপতি আফরোজা খানম রিতা, সাবেক সচিব আব্দুল মতিন—সবাই পৃথকভাবে অথবা একত্রে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেন।
মনিরুল হক চৌধুরী বৈঠক শেষে বলেন, “আমরা চাই ১৯৮৬ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে যেভাবে সংসদীয় আসনের সীমানা ছিল, তা আবার ফিরিয়ে আনা হোক। এই বিষয়ে আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে খসড়া তালিকা দ্রুত প্রকাশের আবেদন জানিয়েছি।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে নয়, ব্যক্তিগতভাবে অথবা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার বাসিন্দা হিসেবে এসেছি। তবে আমাদের দাবিগুলো প্রায় একই।”
আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, “২০০১ সালের নির্বাচন যেভাবে হয়েছিল, আমরা চাই সেই ভিত্তিতে আসনগুলো পুনর্বিন্যাস হোক। এটি জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।”
একই দিন নির্বাচন কমিশনের বাইরে মানববন্ধন ও মৌন সমাবেশ করেন কুমিল্লা-২ আসনের সেলিম ভূঁইয়ার অনুসারীরা। ‘হোমনা-মেঘনা একসঙ্গে রাখার দাবিতে’ আয়োজিত এই কর্মসূচিতে ব্যানার-প্ল্যাকার্ড হাতে অংশগ্রহণ করেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা।
পরে অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া নিজে সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দাবি তুলে ধরেন। সাংবাদিকদের বলেন, “১৯৫৪ সাল থেকে হোমনা ও মেঘনা একই আসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২০০৮ সালে সেটিকে বিভক্ত করা হয়, আর ২০১৮ সালে আবার একীভূত করা হয়। এখন শোনা যাচ্ছে পুনরায় বিভক্তির সম্ভাবনা রয়েছে, যা আমরা চাই না।”
তিনি বলেন, “একই জনগোষ্ঠী, একই এলাকার মানুষ এক আসনে থাকুক, এটি গণতন্ত্রের জন্যই ভালো। আমরা শুধু পুরনো চেহারা বজায় রাখার দাবি করেছি।”
এদিকে নির্বাচন কমিশন খসড়া তালিকা প্রকাশের বিষয়ে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। আজ বৃহস্পতিবার কমিশনের পক্ষ থেকে একটি সভা হওয়ার কথা থাকলেও তা স্থগিত করা হয়েছে, যা ইস্যুটি নিয়ে অনিশ্চয়তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
কমিশন সূত্র বলছে, সীমানা নির্ধারণে কয়েকটি আসন নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কোথাও নতুন উপজেলা সংযোজন, কোথাও জনসংখ্যার পরিবর্তন, আবার কোথাও রাজনৈতিক চাপ—সব মিলিয়ে একটি ‘সন্তোষজনক খসড়া’ উপস্থাপন করতে সময় নিচ্ছে কমিশন।
কমিশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “সীমানা পুনর্বিন্যাসে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত অবশ্যই বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে সবকিছুর বাইরে থাকবে জনসংখ্যা, ভৌগোলিক সংযুক্ততা এবং প্রশাসনিক কাঠামোর যৌক্তিকতা।”
বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী দলের অনেক নেতাই আশঙ্কা করছেন, আসন পুনর্বিন্যাসের নামে ক্ষমতাসীন দল বিশেষ সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। যদিও নির্বাচন কমিশন বারবার বলছে, আসন নির্ধারণ হবে নিরপেক্ষ ও পদ্ধতিগতভাবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, “বর্তমানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন একটি মোড় নিয়েছে, যেখানে বিএনপি ও তাদের সমর্থক নেতারা আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সংগঠিত হচ্ছে। সীমানা নিয়ে সক্রিয়তা তাই কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটি বৃহত্তর কৌশলের অংশ।”
যদিও নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে এখনো কোনো খসড়া তালিকা প্রকাশ হয়নি, তবে বিএনপিপন্থি নেতারা আগেভাগেই নিজের অবস্থান জানান দিতে শুরু করেছেন। এই পদক্ষেপ একদিকে কমিশনের ওপর রাজনৈতিক চাপ বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে আগামী নির্বাচনের আগে আসন পুনর্বিন্যাসকে কেন্দ্র করে একটি নতুন বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে।
দেখা যাক, কমিশন শেষ পর্যন্ত কোন পথে হাঁটে—বাধ্যবাধকতার গণ্ডিতে থেকে নিরপেক্ষভাবে পুনর্বিন্যাস করে, নাকি রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করে। যেকোনো পথই হবে আগামীর রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ