
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) দুই ভাগে বিভক্ত করা এবং বর্তমান চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খানের অপসারণ দাবিতে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লাগাতার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে অবশেষে সরকারের উচ্চপর্যায়ের উদ্যোগে সমাধানের পথ খোঁজা হচ্ছে। চলমান অচলাবস্থার প্রেক্ষিতে আজ বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) বিকেল ৫টায় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এনবিআরের দুই ক্যাডার—বিসিএস (কর) এবং বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ)—এর প্রতিনিধিদের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসছেন।
সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এই বৈঠকের উদ্দেশ্য হবে চলমান সংকট নিরসন, ভুল বোঝাবুঝির অবসান এবং পরিপূর্ণ আলোচনার ভিত্তিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সংস্কার বিষয়ে গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে পৌঁছানো।
বুধবার (২৫ জুন) অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়ী সংগঠন, অর্থনীতিবিদ, সুশীল সমাজ ও উন্নয়ন সহযোগীদের পক্ষ থেকে রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কার্যক্রম পৃথক করার সুপারিশ করে আসছিলেন। এই প্রেক্ষাপটে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গত বছরের ৯ অক্টোবর এনবিআর সংস্কার বিষয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে।
কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি উপদেষ্টা পরিষদের এক বৈঠকে নীতিগতভাবে "রাজস্ব নীতি প্রণয়ন এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনার মধ্যে কার্যকর বিভাজন" অনুমোদন দেওয়া হয়। এর পরই এনবিআরের আওতাধীন বিসিএস (কর) ও বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ক্যাডারের প্রতিনিধিরা অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া প্রণয়ন করেন।
এই খসড়া অধ্যাদেশটি চলতি বছরের মার্চের প্রথম সপ্তাহে এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে সংশোধন ও পুনর্বিবেচনার পর ১২ মে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনে এটি অধ্যাদেশ হিসেবে জারি করা হয়।
তবে অধ্যাদেশটি প্রকাশের পর থেকেই এনবিআরের বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা ও কর্মচারী এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে কলম বিরতি, কর্মবিরতি, মানববন্ধন, শাটডাউন কর্মসূচিসহ লাগাতার আন্দোলনে নেমেছেন। তাদের মূল দাবি—চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খানের অপসারণ ও অধ্যাদেশ বাতিল বা সংশোধন।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে আন্দোলনকারীরা দাবি করছেন, সংশ্লিষ্ট ক্যাডারদের সঙ্গে প্রকৃত আলোচনার ভিত্তিতে সম্মতিসূচক সংস্কার না করে জোরপূর্বক অধ্যাদেশ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা স্বার্থপরিপন্থী এবং প্রশাসনিক ভারসাম্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
চলমান অচলাবস্থা নিরসনের লক্ষ্যে গত ২০ মে অর্থ উপদেষ্টার সভাপতিত্বে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ১৩ জন প্রতিনিধির সঙ্গে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, অধ্যাদেশে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে।
এরপর ২৫ মে অর্থ উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে দেওয়া এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেও বিষয়টি নিশ্চিত করা হয় এবং আন্দোলনকারীদের আহ্বান জানানো হয় কর্মসূচি স্থগিত করতে। তাতে সাড়া দিয়ে আন্দোলনকারীরা সাময়িকভাবে কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন।
কিন্তু ২২ জুন থেকে আবারও আন্দোলন শুরু হলে সরকারের পক্ষ থেকে আরও আলোচনার জন্য নতুন করে বৈঠকের ডাক দেওয়া হয়। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের আমন্ত্রণে আগামীকাল বৃহস্পতিবারের বৈঠকে উভয় পক্ষের মতামত তুলে ধরা হবে এবং সমাধানের পথ নির্ধারণের চেষ্টা করা হবে।
এই আন্দোলনের ফলে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজস্ব প্রশাসন—এনবিআর কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। কর, ভ্যাট ও কাস্টমস বিভাগের শত শত দপ্তরে দৈনন্দিন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ এই সময়টিই অর্থবছরের শেষ সপ্তাহ, যেখানে সর্বোচ্চ রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যে কর্মকর্তাদের সক্রিয় থাকার কথা।
বিজ্ঞপ্তিতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, “৩১ জুলাইয়ের মধ্যে সংশোধনীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই সরকার কাজ করছে। তাই রাজস্ব আহরণ কার্যক্রমে যেন কোনো বিঘ্ন না ঘটে, সে বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। এনবিআরের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজ নিজ দপ্তরে থেকে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে কাজ করার জন্য সরকার উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছে।”
সরকার এই আলোচনাকে শেষ সুযোগ হিসেবে দেখছে—যেখানে সকল পক্ষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্বচ্ছতা, আস্থা ও পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে একটি সম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হবে। যদিও আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চেয়ারম্যানের অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে অনড়, তবুও বৃহৎ অর্থনৈতিক স্বার্থে সমঝোতার প্রয়োজনীয়তা এখন আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
আজ বৃহস্পতিবারের বৈঠকেই হয়তো নির্ধারিত হবে এনবিআর সংস্কার অধ্যায়ের পরবর্তী গতি। এখন শুধু অপেক্ষা আলোচনা কতটা ফলপ্রসূ হয়—তা দেখার।
বাংলাবার্তা/এসজে