
ছবি: সংগৃহীত
ইরানের সঙ্গে টানা ১২ দিনব্যাপী সরাসরি যুদ্ধের পর ইসরাইল বড় ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদের সংকটে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম এনবিসি নিউজ একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এমনটাই জানিয়েছে। প্রতিবেদনে মার্কিন প্রশাসনের একাধিক অজ্ঞাতনামা কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ইসরাইল বর্তমানে ‘গুরুত্বপূর্ণ কিছু অস্ত্রে’ মারাত্মক ঘাটতি অনুভব করছে, যা দেশটির প্রতিরক্ষা সক্ষমতার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
এই খবর এমন সময় সামনে এসেছে, যখন কাতারের মধ্যস্থতায় এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যক্ষ উদ্যোগে ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর রয়েছে। যদিও এটি অত্যন্ত নাজুক পর্যায়ে রয়েছে এবং এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কেউই নিশ্চিত নন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরাইলের অস্ত্রভাণ্ডার থেকে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র, গোলাবারুদ ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিপুল হারে ব্যবহৃত হওয়ায় মজুত ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন প্রতিরোধী ব্যবস্থা এবং স্পষ্ট লক্ষ্যনির্ভর অস্ত্রের জোগানে বিপর্যয় নেমে এসেছে।
একজন মার্কিন কর্মকর্তা এনবিসিকে বলেন, “ইসরাইল এখনও তার আত্মরক্ষার জন্য সক্ষম, কিন্তু আগের মতো দ্রুত পাল্টা আক্রমণ চালানোর মতো স্টক আর নেই।” আরও দুজন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা ইঙ্গিত দেন, ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে দ্রুত পুনঃসরবরাহের অনুরোধ জানিয়েছে।
এদিকে ইসরাইল সরকারের পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য আসেনি। তবে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র জানিয়ে দিয়েছেন, “আমরা আমাদের ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে সমন্বয় করছি।”
গত ১৩ জুন, ইসরাইল এককভাবে ইরানের গোপন পারমাণবিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। একই দিনে ইরানও ‘অপারেশন ট্রু প্রমিস-৩’ নামে নিজেদের প্রতিরক্ষামূলক প্রতিশোধ অভিযান চালায়, যার মাধ্যমে তেলআবিবসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইসরায়েলি সামরিক স্থাপনায় একযোগে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়।
উভয় দেশের এই আঘাত-পাল্টা আঘাত চলতে থাকে প্রায় ১২ দিনব্যাপী, যার ফলে হাজারো মানুষের মৃত্যু, বিপুল ক্ষয়ক্ষতি এবং যুদ্ধজর্জর পরিস্থিতিতে নাগরিকজীবন বিপর্যস্ত হয়। ইরানের সরকারি তথ্যমতে, ইসরাইলের হামলায় তাদের অন্তত ১৭ জন বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই পারমাণবিক গবেষণার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইসরাইলকে প্রতিরক্ষা সহায়তা দেয়, বিশেষ করে আয়রন ডোম ও ডেভিড’স স্লিং ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় রাখতে গোলাবারুদ সরবরাহ করে। এছাড়া মার্কিন নৌবাহিনীর কয়েকটি ইউনিট ভূমধ্যসাগরে মোতায়েন ছিল, যারা ইসরাইলের প্রতিরক্ষায় সহায়তা করে।
এনবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সহায়তা যথেষ্ট না হওয়ায় এবং যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ায় ইসরাইল এখন অতিরিক্ত ও দ্রুত অস্ত্র সহায়তার জন্য পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানিয়েছে।
২২ জুন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় গোপন হামলা চালায়। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরান ২৪ জুন কাতারে অবস্থিত মার্কিন আল উদেইদ বিমানঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। যদিও ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর অধিকাংশ মাঝপথেই প্রতিহত হয় এবং কোনো প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি।
তবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এই হামলার আগে ইরান কাতারকে আগেই সতর্ক করেছিল। বিষয়টি নিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি ইঙ্গিত করে ইরান এই উত্তেজনা আরও বাড়াতে চায় না, বরং যুদ্ধের সীমা নির্ধারণ করে একটি বার্তা দিতে চায়।
এরপর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন এবং দাবি করেন, “দুই দেশই শান্তির জন্য সম্মত হয়েছে।” কিন্তু ইরান এ ধরনের কোনো চুক্তিকে স্বীকার করেনি। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সামরিক বাহিনী পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছে, ইসরাইল যদি আবার আক্রমণ চালায়, তবে তারা তীব্র জবাব দেবে।
এখন পর্যন্ত ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি যুদ্ধবিরতি ইস্যুতে কোনো মন্তব্য করেননি। তাঁর এই নীরবতাকে কৌশলগত হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকরা।
তেহরান বারবার দাবি করছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (IAEA) প্রধান রাফায়েল গ্রোসি বলেছেন, “আমাদের হাতে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই যে ইরান সক্রিয়ভাবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে।”
ইসরাইলের অস্ত্র সংকটের বিষয়ে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাজ্যের সাবেক সিরিয়া বিষয়ক দূত পিটার ফোর্ড। তিনি রাশিয়ার সংবাদ সংস্থা রিয়া নভোস্তিকে বলেন, “ইসরাইল হয়তো যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চাইছে, কিন্তু বাস্তবতা হলো, তাদের গোলাবারুদের মজুত এবং সেনাবাহিনীর মানসিক প্রস্তুতি দুইই বর্তমানে দুর্বল।”
তিনি বলেন, “এই যুদ্ধবিরতি এখনকার প্রেক্ষাপটে টিকে থাকার সম্ভাবনা বেশি। কারণ ইসরাইলেরই এখন শান্তির প্রয়োজন বেশি।”
ইসরাইল-ইরান যুদ্ধবিরতির আড়ালে যেন লুকিয়ে রয়েছে নতুন উত্তেজনার আগুন। তবে বর্তমান বাস্তবতা হলো, ইসরাইল অস্ত্র সংকটে পড়ে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে এবং এখন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে আছে সহায়তার আশায়।
এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক কূটনীতি, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাজেট এবং মধ্যপ্রাচ্যের ভৌগোলিক রাজনীতি—সবকিছু মিলেই নির্ধারণ করবে পরবর্তী সঙ্কট নেমে আসবে কি না। আর ইরানও দেখছে—তার প্রতিরোধের ফল কতটা দীর্ঘস্থায়ী হয়। যুদ্ধবিরতি থাকলেও, যুদ্ধ যে এখনও শেষ হয়নি, সেটা বলাই বাহুল্য।
বাংলাবার্তা/এমএইচ