
ছবি: সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের পর টানা কয়েকদিন ধরে উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তায় কাঁপছিল বৈশ্বিক অর্থনীতি, যার ঢেউ এসে আঘাত হানে বাংলাদেশের ওপরেও। যুদ্ধবিরতির ঘোষণায় সাময়িক স্বস্তি এলেও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীদের মতে, এখনো কাটেনি সেই শঙ্কা। বিশেষত হরমুজ প্রণালি ঘিরে আশঙ্কা এবং জ্বালানির সরবরাহ ও মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। ফলে দেশের অর্থনীতিতে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে হলে এখনও অপেক্ষা করতে হবে বাস্তব পরিস্থিতির স্পষ্ট রূপ প্রকাশের।
ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে ১২ দিন ধরে চলা সরাসরি সামরিক সংঘাতের পর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় কাতারের সহায়তায় ঘোষিত যুদ্ধবিরতিকে অর্থনীতিবিদরা ‘স্বস্তির সম্ভাব্য দরজা’ বলে উল্লেখ করলেও বাস্তবে তা কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, "ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতির বিষয়ে ঘোষণার পর আমাদের আশঙ্কা কিছুটা কমেছে ঠিকই, কিন্তু সেই ঘোষণা কতটা কার্যকর, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। ফলে অর্থনীতিতে এখনই স্বস্তি এসেছে বলা যাবে না। বাস্তবতা দেখেই নিশ্চিত হওয়া যাবে।"
বাংলাদেশের জ্বালানি আমদানি কাঠামোতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র পথ হরমুজ প্রণালি। এই করিডরটি দিয়ে আসে দেশের মোট জ্বালানি আমদানির প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ। ইরান যদি হরমুজ প্রণালি সাময়িক সময়ের জন্যও বন্ধ করে দেয়, তবে জ্বালানি সরবরাহে ভয়াবহ অচলাবস্থা তৈরি হতে পারে। যদিও যুদ্ধবিরতির পর আপাতত প্রণালি খোলা রয়েছে, কিন্তু এই চ্যানেলের নিরাপত্তা নিয়ে এখনও রয়েছে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ।
এফবিসিসিআইর সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, "জ্বালানির দাম ও সরবরাহ নিয়ে যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, সেটি এখনও পুরোপুরি কাটেনি। হরমুজ প্রণালি পুরোপুরি সুরক্ষিত আছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। এই রুট বন্ধ হয়ে গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভয়াবহ চাপে পড়ে যাবে।"
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান দুর্বলতা হলো জ্বালানির উপর আমদানিনির্ভরতা। যুদ্ধের কারণে জ্বালানি সংকট তৈরি হলে এর তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়বে মুদ্রাস্ফীতি, শিল্প উৎপাদন, কৃষি, পরিবহন ও ভোক্তা পর্যায়ে।
অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান বলেন, "যুদ্ধের কারণে অপরিশোধিত জ্বালানির দাম যদি বাড়ে, তাহলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বাড়বে, যা সরাসরি শিল্পখাতে খরচ বাড়িয়ে দেবে। কৃষি উৎপাদনে সেচ খরচ বাড়বে, ট্রান্সপোর্ট খরচ বাড়বে এবং এইসবের সমন্বয়ে ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধি অবধারিত হয়ে দাঁড়াবে।"
তিনি আরও বলেন, "এছাড়া রিজার্ভের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে, টাকার মান দুর্বল হবে এবং সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্য টালমাটাল হয়ে পড়তে পারে।"
চলতি জুন মাসেই ঘোষিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সরকার বহির্মুখী চাপ মোকাবিলাকে অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বাজেট বক্তৃতা এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যমেয়াদি অর্থনৈতিক নীতি দলিলে যুদ্ধ, ভূ-রাজনৈতিক সংকট ও বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধিকে উদ্বেগের উৎস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ এই বহির্মুখী চাপে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। কারণ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে আগে থেকেই সরবরাহ ব্যবস্থায় টান ছিল, তার উপর মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা বাড়লে আন্তর্জাতিক পণ্যমূল্য আরও ঊর্ধ্বমুখী হবে—এমনটা বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদের আশঙ্কা।
বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিরা বলছেন, শুধু সরাসরি জ্বালানি সংকট নয়, রপ্তানি বাজারে অস্থিরতা, কাঁচামালের দাম বাড়া ও বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহে টান পড়ার মতো আশঙ্কাও তারা দেখছেন। তার ওপর ডলারের বাজার স্থিতিশীল না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, "যুদ্ধ পরিস্থিতি পুরোপুরি ঠান্ডা না হলে আমরা ব্যবসায়ী হিসেবে কোনো পরিকল্পনা করতে পারি না। প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে দ্বিধায় পড়তে হচ্ছে—ভবিষ্যতে কি জ্বালানির দাম বাড়বে, কাঁচামালের চালান আসবে তো?"
সামগ্রিকভাবে, যুদ্ধবিরতির ঘোষণাকে বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির জন্য সম্ভাব্য ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা বলা যায়। কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে মিলে না গেলে এই ঘোষণা কোনো অর্থনৈতিক স্বস্তি বয়ে আনবে না।
অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং সরকার—তিন পক্ষই একমত যে, ইরান ও ইসরায়েল প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তিপূর্ণ অবস্থানে ফিরে গেলে তবেই দেশের অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরবে। এর আগে পর্যন্ত সবকিছুই এক অনিশ্চয়তার মেঘে ঢাকা থাকবে।
সেই মেঘ কবে কেটে যাবে—প্রশ্নটা এখন সময়ের।
বাংলাবার্তা/এমএইচ