
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রাথমিক মূল্যায়ন সম্প্রতি ফাঁস হওয়ার পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ভবিষ্যৎ। ফাঁস হওয়া তথ্য যদি সঠিক হয়, তাহলে এমন প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠছে—ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেটেড বিমান হামলা কি ইরানকে পারমাণবিক কর্মসূচি গতি বাড়াতে আরও উৎসাহিত করবে?
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিকাঠামো পুনর্গঠন এবং নিহত বিজ্ঞানীদের বদলে নতুনদের নিযুক্ত করার মাধ্যমে তেহরান হয়তো তার পারমাণবিক কর্মসূচিকে আরও আগ্রাসীভাবে এগিয়ে নিতে পারে।
ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ হামলায় ইরানের পারমাণবিক সুবিধাগুলোর কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা এখনও পুরোপুরি নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন উপগ্রহ চিত্র ও ভূগোলভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, বেশ কয়েকটি গোপন গবেষণাগারে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তবে এই হামলা ইরানের পারমাণবিক কর্মকাণ্ড স্থগিত করেছে না ত্বরান্বিত করবে, সেটি নির্ভর করছে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর।
ইরানি কর্মকর্তারা ইতোমধ্যেই স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন—তাদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, “ইরান কখনই পারমাণবিক শক্তি অর্জন করতে পারবে না।”
তবে পর্যবেক্ষকদের মতে, এসব বক্তব্য ইরানকে চাপে ফেলতে যতটা না কার্যকর, তার চেয়ে বেশি প্রমাণ করছে যে তেহরান এখন একটি ‘রেড লাইন’ অতিক্রম করেছে এবং পারমাণবিক অস্ত্রই ভবিষ্যতের প্রতিরক্ষা নীতি হয়ে উঠতে পারে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, উত্তর কোরিয়ার অভিজ্ঞতা ইরানের কৌশল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে বহু বছর ধরে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, সামরিক হুমকি ও কূটনৈতিক চাপে রেখেও দেশটি পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করেছে। এবং অস্ত্রধারী হবার পর থেকে, কেউ তাদের সরাসরি আক্রমণ করেনি।
ইরানও হয়তো এই বিশ্লেষণ থেকেই উপসংহারে এসেছে—পারমাণবিক অস্ত্রই একমাত্র নিরাপত্তার গ্যারান্টি।
বুধবার ইরানের সংসদে গৃহীত একটি বিল অনুযায়ী, দেশটি আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA)-এর সঙ্গে সহযোগিতা সীমিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর পাশাপাশি, কয়েকজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা এমনটিও বলছেন যে ইরান এনপিটি (পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি) থেকেও বেরিয়ে যেতে পারে।
এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক মহলে গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। পশ্চিমা কূটনীতিকরা মনে করছেন, এই পদক্ষেপগুলো তেহরানকে আন্তর্জাতিক নজরদারি থেকে মুক্ত করে তার সামরিক কর্মসূচিকে গোপনে এগিয়ে নিতে সাহায্য করতে পারে।
ইরানের কাছে বর্তমানে প্রায় ৪০০ কেজি ৬০ শতাংশ মাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুত রয়েছে, যা পরমাণু অস্ত্র তৈরির জন্য নির্ধারিত ৯০ শতাংশ মাত্রার এক ধাপ নিচে। এ বিষয়ে পশ্চিমা বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিমাণ ইউরেনিয়াম থেকে একাধিক নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড তৈরি সম্ভব, যদি ইরান চায়।
কিন্তু এই ইউরেনিয়াম এখন কোথায় রয়েছে, কিভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে বা তা থেকে আর কি প্রক্রিয়া চলছে—তা সম্পর্কে খুব সামান্যই তথ্য রয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে।
বর্তমানে ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি বিরাজ করছে। এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক কূটনীতিকরা নতুন পারমাণবিক চুক্তির উদ্যোগ নিতে পারেন, এমন সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে এই আলোচনার সামনে আছে এক বড় চ্যালেঞ্জ—যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শর্ত হলো, ইরান সম্পূর্ণভাবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম বন্ধ করবে। কিন্তু তেহরান বরাবরই এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে এসেছে।
সাম্প্রতিক ফক্স নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ বলেন, “এখন সময় এসেছে ইরানিদের সঙ্গে বসে একটি পূর্ণাঙ্গ শান্তিচুক্তি করার। আমরা জানি, এটা সহজ হবে না।”
বর্তমানে আন্তর্জাতিক চাপ, অর্থনৈতিক অবরোধ এবং সামরিক হুমকির মুখে ইরান একটি দুর্বল কূটনৈতিক অবস্থানে রয়েছে, তবে দেশটির শীর্ষ নেতৃত্ব এখনো নিজেদের অবস্থান পাল্টানোর কোনও ইঙ্গিত দেয়নি।
তারা বরং এই বিশ্বাসে দৃঢ় যে, পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন করলেই পশ্চিমা হুমকিকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করা যাবে।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির গতি বাড়বে কি না—এটি নির্ভর করছে দুইটি বিষয়ের ওপর: ১. পশ্চিমা বিশ্ব কতটা চাপ প্রয়োগ করতে পারে, এবং ২. ইরান তার নিরাপত্তা কৌশল কতটা পুনর্বিবেচনা করতে রাজি।
বর্তমান বাস্তবতায় যতই কূটনৈতিক প্রচেষ্টা হোক না কেন, যদি তেহরান অনুভব করে যে পারমাণবিক অস্ত্রই টিকে থাকার একমাত্র পথ, তাহলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে নতুন এক পরমাণু শক্তির আবির্ভাব অপ্রত্যাশিত নয়।
ইরানকে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে আনতে হলে শুধু হুমকি নয়, দরকার হবে বিশ্বাসযোগ্য কূটনীতি, অর্থনৈতিক প্রণোদনা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে নতুন চুক্তি। না হলে, মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি পরমাণু শক্তির উদ্ভব কেবল সময়ের অপেক্ষা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ