
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ব চলচ্চিত্রে বলিউড ও ভারতের আঞ্চলিক ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিগুলোর অবস্থান আজকের দিনে যে কোনো সন্দেহাতীত। চলচ্চিত্র নির্মাণের সংখ্যায় ভারত এগিয়ে আছে বিশ্বের শীর্ষে। প্রতিভাবান নির্মাতা, সাহসী গল্প এবং বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট—সব মিলিয়ে ভারতীয় সিনেমা এক শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
তবে দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের সিনেমা সেন্সর বোর্ড (বর্তমানে CBFC - Central Board of Film Certification) সিনেমার বিষয়বস্তু, সংলাপ, নগ্নতা, সহিংসতা বা ধর্মীয় উপস্থাপনা নিয়ে কঠোর নজরদারি চালিয়ে আসছে। বিশেষ করে যৌনতা ও নগ্নতা সংবলিত বিষয়বস্তুকে বারবার ‘সামাজিক শালীনতা ও সংস্কৃতির পরিপন্থী’ আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করেছে বহু সিনেমা।
আজকের প্রতিবেদনে থাকছে এমন ৭টি সাহসী ও বিতর্কিত সিনেমার তালিকা, যেগুলোর অতিরিক্ত নগ্নতা বা আপত্তিকর বিষয়বস্তুর কারণে ভারতে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়নি, যদিও কিছু ছবি আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত হয়।
১. গান্ডু (Gandu) – ২০১০
পরিচালক: কৌশিক মুখার্জি (কিউ)
ভাষা: বাংলা
অভিনয়ে: ঋ সেন, অনুব্রত বসু, কমলিকা ব্যানার্জি
এই ছবিটি এক সাহসী পরীক্ষামূলক নির্মাণ, যেখানে হিপ-হপ সংগীতের সঙ্গে এক বেকার যুবকের হতাশা, মাদকাসক্তি, হস্তমৈথুন এবং যৌনতা মিশে আছে এক নতুন ফর্মে।
ছবিটির নগ্নতা এবং হস্তমৈথুন দৃশ্যকে ঘিরে ব্যাপক বিতর্ক হয়। সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ফিল্ম সার্টিফিকেশন (CBFC) ছবিটিকে কোনো সার্টিফিকেট না দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। যদিও বিদেশি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এটি প্রশংসিত হয়েছিল, ভারতে কখনোই মুক্তি পায়নি।
২. কামাসূত্র: দ্য টেল অব লাভ (Kama Sutra: A Tale of Love) – ১৯৯৬
পরিচালক: মীরা নায়ার
অভিনয়ে: ইন্দিরা ভার্মা, রমন ত্রিখা, রেজিনা ক্যাসান্দ্রা, রেখা
ভাস্বতীর প্রাচীন যৌনগ্রন্থ অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিতে নগ্নতা ও প্রেম-শারীরিক সম্পর্কের দৃষ্টিভঙ্গিকে উপস্থাপন করা হয় এক নান্দনিক আঙ্গিকে।
তবে সেসময়ে ভারতের প্রচলিত সামাজিক প্রেক্ষাপট ও রক্ষণশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে সেন্সর বোর্ড ছবিটিকে মুক্তির অনুমতি দেয়নি। আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবিটি উচ্চ প্রশংসিত হলেও ভারতে এটি নিষিদ্ধই থেকে যায়।
৩. আনফ্রিডম (Unfreedom) – ২০১৫
পরিচালক: রাজ অমর মিত্রা
অভিনয়ে: প্রীতি গুপ্তা, আদিল হুসেন, ভবানী লি
এই ছবিতে দুইটি মূল কাহিনি—একটি মুসলিম চরমপন্থী এক জঙ্গি বন্দী ও তার ব্যক্তিগত বিশ্বাসঘাতকতা, অন্যটি একজন নারীর সঙ্গে অপর নারীর সম্পর্ক নিয়ে।
সমকামিতা, নগ্নতা ও ধর্মীয় মৌলবাদকে একসঙ্গে চ্যালেঞ্জ করায় ছবিটি সেন্সর বোর্ডের চোখে আপত্তিকর হয়ে ওঠে। ছবির বেশ কিছু দৃশ্যকে “উগ্র ও সাংঘর্ষিক” আখ্যা দিয়ে CBFC কোনো প্রকার ছাড়পত্র দেয়নি। ফলে এটি ভারতে কখনো মুক্তি পায়নি।
৪. পাঁচ (Paanch) – ২০০৩
পরিচালক: অনুরাগ কাশ্যপ
অভিনয়ে: কেকে মেনন, তেজস্বিনী কোলহাপুরী, আদিত্য শ্রীবাস্তব
পাঁচজন যুবকের অপরাধজগতে প্রবেশ এবং তার পরিণতি নিয়ে নির্মিত ‘পাঁচ’ ছিল অনুরাগ কাশ্যপের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা।
মাদক গ্রহণ, সহিংসতা, নগ্নতা ও ভাষার ব্যবহার নিয়ে সেন্সর বোর্ড ছবিটিকে মুক্তির জন্য বারবার আপত্তি জানায়। যদিও এটি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়নি, তবে মুক্তির অনুমোদন না মেলায় প্রেক্ষাগৃহে কোনোদিনও মুক্তি পায়নি।
৫. সিনস (Sins) – ২০০৫
পরিচালক: ভিনোদ পাধায়ে
অভিনয়ে: শাইনি আহুজা, সীমা রহমানি
একজন ক্যাথলিক পাদ্রির যৌন ইচ্ছা ও এক নারীর সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে তৈরি এই সিনেমা সরাসরি ভারতীয় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়ে।
সিনেমার নগ্ন দৃশ্য, সাহসী সংলাপ ও ধর্মীয় উপস্থাপন সেন্সর বোর্ডকে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ এই যুক্তিতে ছবিটি নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে ভারতে এটি কখনো প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হয়নি।
৬. দ্য পেইন্টেড হাউজ (The Painted House) – ২০১৫
পরিচালক: স্যঞ্জীব সুরেন্দ্রন
ভাষা: মালয়ালম
অভিনয়ে: নেহা মহাজন, কালাধরন নাসির, আকরাম মোহাম্মদ
একজন চিত্রশিল্পী ও তার কিশোরী মডেলের মধ্যে গড়ে ওঠা সম্পর্ক এবং যৌন বিকারগ্রস্ততাকে ঘিরে তৈরি এই ছবিটি চরম বিতর্কের জন্ম দেয়। ছবিতে নগ্নতা ও যৌন দৃশ্য এতটাই সাহসী ছিল যে CBFC একে ‘অশ্লীল ও নৈতিক অবক্ষয়ের’ উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে নিষিদ্ধ করে দেয়।
৭. মালিক (Malik) – ১৯৭২
পরিচালক: এস এম শাহিদ
অভিনয়ে: রাজেশ খান্না, শর্মিলা ঠাকুর
এই ছবিতে যৌনতা ছাড়াও ইসলাম ধর্ম নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক উপস্থাপনা ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। তৎকালীন সেন্সর বোর্ড এ বিষয়গুলোকে ‘সমাজে অশান্তি সৃষ্টির সম্ভাব্য কারণ’ উল্লেখ করে ছবিটির মুক্তি বাতিল করে দেয়। তবে এ ছবি কিছু ফিল্ম উৎসবে প্রশংসিত হয়।
ভারতের চলচ্চিত্র শিল্প একদিকে যেমন বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত, অন্যদিকে সেন্সর বোর্ডের কঠোরতার জন্য অনেক সাহসী ও নতুন ধারার ছবি দিনের আলো দেখেনি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বনাম সামাজিক মূল্যবোধের দ্বন্দ্বে এখনও বহু নির্মাতা আটকে পড়ছেন।
এই প্রতিবেদন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, সিনেমা শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়—এটি প্রতিবাদ, অভিব্যক্তি ও পরিবর্তনের শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম। তবে সেই প্ল্যাটফর্মকে প্রকাশের স্বাধীনতা কতটা থাকবে, তা এখনও নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যাখ্যার মধ্যেই রয়ে গেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ