
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ ১২ দিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর দুই দিন পেরিয়ে গেলেও যখন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি নীরব ছিলেন, তখন দেশব্যাপী এবং আন্তর্জাতিক মহলে তৈরি হয়েছিল নানা গুঞ্জন ও উদ্বেগ। শেষ পর্যন্ত সেই নীরবতা ভেঙে বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটার) এবং টেলিগ্রামে একাধিক বার্তায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিজয়ের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। তার এই বক্তব্যে ইরানের জনগণের মনে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
এক্স-এ দেওয়া খামেনির বার্তায় তিনি লেখেন— “ইসলামী প্রজাতন্ত্রের আঘাতে জায়নিস্ট শাসনব্যবস্থা তাদের সব দাবি ও অহংকারসহ প্রায় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। এই প্রতারণাপূর্ণ ও দখলদার শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিজয় অর্জনের জন্য আমি ইরানের জনগণকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।”
এ বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি সরাসরি যুদ্ধের ফলাফলকে ইরানের জন্য একটি কৌশলগত ও রাজনৈতিক বিজয় হিসেবে উপস্থাপন করেন, যদিও বাস্তবে যুদ্ধবিরতি এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় এবং উভয় পক্ষই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে।
খামেনি টেলিগ্রামে ফারসি ভাষায় আরও একটি বার্তা দিয়েছেন, যেখানে তিনি ইরানিদের ‘ঐক্যবদ্ধ জাতি’ হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি লেখেন— “প্রায় ৯ কোটি মানুষের একটি জাতি, যারা সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়েছে, তারা দেখিয়ে দিয়েছে এই জাতি কতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমি তৃতীয়বারের মতো এই বিজয়ের জন্য দেশবাসীকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। তাদের ঐক্য, শৃঙ্খলা ও সাহসিকতা ইরানের স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ করেছে।”
তিনি বলেন, “ইরানি জাতি আবারও প্রমাণ করেছে— প্রয়োজন হলে পুরো জাতি একটি কণ্ঠস্বরেই কথা বলে। এটাই ইসলামী বিপ্লবের প্রকৃত শক্তি।”
যুদ্ধবিরতির পর সর্বোচ্চ নেতার অনুপস্থিতি নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছিল, সেটি শুধু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে নয়, ইরানের ভেতরেও প্রতিফলিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, সোমবার ও মঙ্গলবার ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের একটি টকশোতে উপস্থাপক সরাসরি বলেন, ‘খামেনি এখন কোথায়?’
দর্শকদের পাঠানো শত শত প্রশ্ন উপস্থাপক তুলে ধরেন এবং খামেনির স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত খামেনির দপ্তরের আর্কাইভ কর্মকর্তা মেহদি ফাজায়েলিকে জিজ্ঞেস করেন, “তার অবস্থা কেমন? জনগণ খুবই চিন্তিত।”
তবে ফাজায়েলি কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর না দিয়ে বলেন, “আমরাও বিভিন্ন সূত্র থেকে উদ্বেগের খবর পাচ্ছি। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের ভয়াবহ বোমা হামলার পর সর্বোচ্চ নেতার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ স্বাভাবিক। তবে আমাদের সবাইকে তার জন্য দোয়া করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “যারা তাকে রক্ষা করার দায়িত্বে আছেন, তারা তাদের কাজ ভালোভাবেই করছেন। আল্লাহ চাইলে, আমরা আমাদের নেতাকে সঙ্গে নিয়েই বিজয় উদযাপন করব।”
ইরানের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে, খামেনি শিগগিরই জাতির উদ্দেশে একটি ভাষণ দেবেন। ধারণা করা হচ্ছে, এই ভাষণে তিনি যুদ্ধের পটভূমি, সামরিক ও কূটনৈতিক ফলাফল এবং ভবিষ্যৎ কৌশল নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেবেন।
এই ঘোষণা ইঙ্গিত দিচ্ছে, খামেনি শুধু ধর্মীয় নেতা হিসেবে নয়, রাজনৈতিকভাবেও ইরানের জনগণকে আরও একবার সংঘবদ্ধ রাখার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, এই ভাষণ হতে পারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামরিক সিদ্ধান্তের ইঙ্গিতবাহী, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল এবং আঞ্চলিক জোটগুলোর প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষিতে।
ইসরাইল এই ঘোষণার আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া না দিলেও, পশ্চিমা বিশ্বে এই বার্তাকে ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ হিসেবেই বিবেচনা করছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, বাস্তবে যুদ্ধের ফলাফল কার পক্ষে গেছে, তা এখনো নির্ধারিত নয়। তবে খামেনির এই বিজয় ঘোষণার পেছনে রাজনৈতিক বার্তা স্পষ্ট— ইরান নিজেদের জনগণকে আশ্বস্ত করতে চায় যে, তারা পিছু হটেনি।
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি যুদ্ধবিরতির দুই দিন পর প্রথমবারের মতো সরাসরি বক্তব্য দিয়ে নিজের অনুপস্থিতি নিয়ে ছড়িয়ে পড়া নানা গুজব ও উদ্বেগ দূর করার চেষ্টা করেছেন। তিনি ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে ‘বিজয়’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে জনগণের ধৈর্য, সাহস এবং ঐক্যের প্রশংসা করেছেন।
এই বক্তব্যে তিনি ভবিষ্যতের জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ ইরানের রূপরেখা তুলে ধরেছেন এবং আভাস দিয়েছেন যে, শিগগিরই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়ে জাতিকে আরও দিকনির্দেশনা দেবেন। যুদ্ধ শেষ হলেও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা এখনো পুরোপুরি প্রশমিত হয়নি, বরং খামেনির বক্তব্য সেই উত্তাপকে নতুন মাত্রা দিতে পারে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ