
ছবি: সংগৃহীত
রাষ্ট্রদ্রোহ, অসাংবিধানিক কার্যক্রমে সহযোগিতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে জাতির সঙ্গে প্রহসনের নির্বাচনী নাটক মঞ্চস্থ করার গুরুতর অভিযোগে রাজধানীর শেরে বাংলা নগর থানায় দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) তাকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানের আদালতে হাজির করা হলে শুনানির সময় তিনি প্রকাশ্যে স্বীকার করেন, “আমি ডামি নির্বাচন করেছি।” এ স্বীকারোক্তির পর পুরো আদালতপাড়া, রাজনৈতিক অঙ্গন এবং সাধারণ জনগণের মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।
বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা ২৫ মিনিটে কাজী হাবিবুল আউয়ালকে আদালতের কাঠগড়ায় তোলা হয়। বিচারক এজলাসে প্রবেশ করেন দুপুর দেড়টার দিকে। এরপর রাষ্ট্রপক্ষে পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী এবং আসামিপক্ষের আইনজীবীরা শুনানিতে অংশ নেন। বিচারক যখন মন্তব্য করেন, “আপনার কাছে জাতির প্রত্যাশা ছিল অনেক। কিন্তু বিতর্কমুক্ত নির্বাচন আপনি উপহার দিতে পারেননি,” তখন কাজী হাবিবুল আউয়াল সরাসরি বলেন—
“হ্যাঁ, স্বীকার করছি— আমি ডামি নির্বাচন করেছি। রাজনৈতিক সমঝোতার অভাবে একতরফা নির্বাচন হয়েছে। তবে এ নির্বাচনে আমি কোনো টাকার বিনিময়ে কাজ করিনি। আমি ঘুষ নেইনি, দুর্নীতিতে জড়াইনি।”
আদালতে নিজের বক্তব্যে তিনি অতীত ইতিহাস টেনে এনে বলেন, “ক্ষমতার লোভ শেখ মুজিবও সামলাতে পারেননি। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে সংবিধান রচিত হওয়ার পর ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে তিনিও কারচুপি করেছেন। বাংলাদেশে এমন কোন নির্বাচন আছে যা বিতর্কিত হয়নি?”
তখন আদালতের পিপি ওমর ফারুক ফারুকী ও অন্য আইনজীবীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং বলেন, “এখানে সাধু সাজার সুযোগ নেই। আপনি যা করেছেন সেটার দায় নিতে হবে। অন্যরা কী করেছে সেটা বলে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা যাবে না।” এ সময় এক আইনজীবী বলেন, “এতগুলো ছেলে-মেয়ে মারা গেছে আপনার জন্য।” এর উত্তরে হাবিবুল আউয়াল পালটা প্রশ্ন ছুড়ে দেন, “আমার জন্য এতগুলো ছেলে-মেয়ে মারা গেছে?”
পাবলিক প্রসিকিউটর ফারুকী বলেন, “২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনাকে তিনি বলেছিলেন— ‘আপনার চিন্তা করার কিছু নেই। আমি আপনাকে বিজয়ী ঘোষণা করে দেব। আর আপনি যেটুকু টাকা দেবেন, সেটা আমি পকেটে রাখব।’”
তিনি আরও বলেন, “সাধারণত নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ২০-২৫ হাজার টাকা ভাতা দেওয়া হয়। অথচ ওই নির্বাচনে ৪-৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। কেন এমন হলো?”
এই প্রশ্নের জবাবে কাজী হাবিবুল আউয়াল দায়িত্ব এড়িয়ে বলেন, “যখন রাতের বেলায় ভোট হয়, তখন আমি গভীর নিদ্রায় থাকি।”
বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করিমের ওপর হামলা নিয়ে কথা বলার সময়ও তিনি বিতর্কিত মন্তব্য করেন। আদালতে বলেন, “আমি কথোপকথনে বলেছিলাম— তিনি কি ইন্তেকাল করেছেন? এটিকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।”
পিপি ওমর ফারুক ফারুকী তখন বলেন, “আপনার বক্তব্যে কোনো অনুশোচনা নেই, বরং আপনি বারবার নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে ব্যস্ত। জাস্টিফিকেশন দিয়ে আপনি বিচার থেকে বাঁচতে পারবেন না।” উত্তরে হাবিবুল বলেন, “জাস্টিফাই করার সুযোগ না দিলে, একটা জীবনকে মেরে ফেলেন।”
রাষ্ট্রপক্ষের দাবি, হাবিবুল আউয়াল দেশের সর্বোচ্চ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে সেই পবিত্র দায়িত্বের চরম অবমূল্যায়ন করেছেন। সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে একতরফা নির্বাচন দিয়েছেন। “তিনি ভোটারবিহীন, প্রার্থীবিহীন, পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্রকে হত্যা করেছেন,” বলেন পাবলিক প্রসিকিউটর।
দীর্ঘ শুনানির পর রাষ্ট্রপক্ষ ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে বিচারক তা আংশিক মঞ্জুর করে তিন দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন।
সাবেক সিইসি হাবিবুল আউয়ালের এই স্বীকারোক্তি এবং আদালতের পর্যবেক্ষণ দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও ইতোমধ্যে প্রতিক্রিয়া আসতে শুরু করেছে। বিরোধী দলগুলো বলছে, এটা প্রমাণ করে যে ২০২৪ সালের নির্বাচন ছিল 'নাটক', যেখানে জনগণের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না।
এ ঘটনায় দেশের বিচার বিভাগ, রাজনীতি ও প্রশাসনের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও পবিত্রতা পুনরুদ্ধারে নতুন করে প্রশ্ন উঠে এসেছে। জনগণ জানতে চায়— শুধুই কি স্বীকারোক্তি যথেষ্ট, নাকি হবে এর বিচার?
বাংলাবার্তা/এমএইচ