ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যেন এখন কার্যত অচল এক প্রশাসনিক ভবন। সর্বোচ্চ রাজস্ব প্রশাসনের অভ্যন্তরে আন্দোলন, প্রতিরোধ ও অবরোধের এক জটিল সমীকরণে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজধানীর আগারগাঁও। এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খানের পদত্যাগসহ চার দফা দাবিতে আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েও শেষ পর্যন্ত এনবিআরের গেটে প্রবেশ করতে পারেননি।
কারণ, সকাল থেকেই এনবিআরের মূল ফটক ও ভবনের নিচতলা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও গোয়েন্দা সদস্য প্রধান প্রবেশপথে অবস্থান নেন। ফলে অফিস খুললেও কর্মকর্তা-কর্মচারী তো দূরে থাক, সাধারণ সেবা প্রত্যাশীরাও প্রবেশ করতে পারেননি ভবনে। এ অবস্থায় এনবিআর কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। কর্মক্ষেত্রের পরিবর্তে এনবিআরের সামনের সড়ক পরিণত হয় বিক্ষোভস্থলে।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে আন্দোলনে অংশ নেওয়া একজন সিনিয়র কাস্টমস কর্মকর্তা বলেন, “সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে আমরা আমাদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী এনবিআরে প্রবেশ করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। বলছে, ভবনে প্রবেশ নিষিদ্ধ। আমাদের জিজ্ঞেস করা হলে জানায়, উর্ধ্বতনদের নির্দেশ রয়েছে। এ নির্দেশ যে এনবিআর চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকেই এসেছে, তা আমরা নিশ্চিত।”
একই অভিযোগ আরও অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর কণ্ঠে। এনবিআর স্টাফ কলেজ থেকে আসা একজন দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা বলেন, “চেয়ারম্যান সাহেব বুঝাতে চাচ্ছেন, এনবিআরের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও প্রতিবাদকে আইনশৃঙ্খলা দিয়ে দমন করা যাবে। আমরা বলছি, সেটা হবে না। আমরা রাস্তায় বসবো, শান্তিপূর্ণভাবে বসবো। কিন্তু দাবি না মানা পর্যন্ত সরবো না।”
সকাল থেকে কয়েক দফায় পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডা হয়। পুলিশ জানায়, ‘উর্ধ্বতন নির্দেশনায়’ এনবিআরে প্রবেশ আপাতত সীমিত করা হয়েছে। আন্দোলনকারীরা বলেন, এই ব্যবস্থা অবৈধ ও অসাংবিধানিক।
এক পর্যায়ে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা গেটের রেলিং ধরে শ্লোগান দিতে থাকেন, “চেয়ারম্যানের পতন চাই”, “আমরা রাজস্বের সৈনিক, পুলিশ দিয়ে ঠেকানো যাবে না”, “চাকরি আমাদের অধিকার, অপমান মানব না!”।
বিকেল ৩টা পর্যন্ত এনবিআরের ভেতরে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। বাইরে অবস্থান করা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য কোনো সanitary ব্যবস্থা, পানির ব্যবস্থা ছিল না। দীর্ঘ সময় ধরে বসে থাকার কারণে অনেকে অসুস্থ বোধ করেন। কিন্তু আন্দোলনের মাঠ ছাড়েননি কেউই।
এদিন করদাতাসহ বহু সাধারণ মানুষ নির্ধারিত সময়মতো বিভিন্ন কর, ভ্যাট ও কাস্টমস সেবা নিতে এসে ফিরে গেছেন। রাজধানীর উত্তরা থেকে আসা একজন ব্যবসায়ী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমার এক্সপোর্ট পেমেন্ট আটকে আছে। এনবিআরে একটি ছাড়পত্র লাগবে। সকাল ১০টা থেকে বসে আছি, ঢুকতেই দিচ্ছে না। এটা কিসের প্রশাসন?”
একজন আমদানিকারক বলেন, “আমার কাস্টমস অনুমোদন লাগবে আজকের মধ্যে। এখন যদি ঢুকতেই না পারি, তাহলে লোকসানের মুখে পড়বো।”
চলমান আন্দোলন এবং এনবিআরের প্রধান গেটে পুলিশ মোতায়েন নিয়ে চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খান এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেননি। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, “চেয়ারম্যান ইচ্ছে করেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে ভীতি ও আতঙ্ক তৈরি করতে চাইছেন।”
তারা আরও বলেন, “সংস্কার বিরোধী মনোভাবের কারণেই বারবার আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করছেন তিনি। অথচ তিনিই এখন পর্যন্ত কোনো সংবাদ সম্মেলনে এসে জাতিকে জানাননি— কেন এই আন্দোলন শুরু হলো, এবং তিনি পদত্যাগে রাজি কিনা।”
চেয়ারম্যানের পদত্যাগ ছাড়াও বাকি তিনটি দাবি হলো—
১. এনবিআরকে দুই ভাগে ভাগ করে পৃথক রাজস্ব অধিদপ্তর গঠনের অধ্যাদেশ বাতিল
২. কর্মকর্তাদের হয়রানি বন্ধ করা
৩. এনবিআরের কর্মপরিকল্পনায় মাঠপর্যায়ের যৌক্তিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা
আন্দোলনকারীরা বলছেন, “এই দাবিগুলো কোনোভাবেই অন্যায় নয়। এটা আমাদের পেশাগত মর্যাদা রক্ষার প্রশ্ন। আমরা চাকরি চাই, গোলামি নয়।”
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, কেন এনবিআরের মতো একটি প্রশাসনিক ভবনে দিনভর এত সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন থাকবে? কার নির্দেশে গেট বন্ধ করে দেওয়া হলো? এ ঘটনায় স্বচ্ছ তদন্ত ও ব্যাখ্যার দাবি জানিয়েছেন কিছু সচেতন নাগরিক।
সরকারি এক উচ্চপদস্থ সূত্র বলেছে, “সরকার চায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকুক। কিন্তু শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশের এভাবে গেট বন্ধ করে দেওয়া কিছুটা অস্বাভাবিক।”
বৃহস্পতিবার শেষ বিকেলেও আন্দোলনকারীরা গেটের সামনে ডিএফএল অফিস পর্যন্ত অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। আন্দোলনকারীদের পরিষ্কার বক্তব্য— “চেয়ারম্যানকে যেতে হবেই। আন্দোলন এবার নরম হবে না। পুলিশ দিয়ে দমন নয়, আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চাই।”
এই অবস্থান থেকে সরে না আসা পর্যন্ত এনবিআরের কর্মকাণ্ড কার্যত স্থবির থাকছে বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন। সরকারের পক্ষ থেকে এখনো পর্যন্ত বিষয়টির কোনো ইতিবাচক সমাধানের ইঙ্গিত আসেনি। ফলে রাজস্ব আদায়, আমদানি-রপ্তানি ছাড়পত্রসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে বড়সড় বিঘ্ন ঘটতে পারে বলেই শঙ্কা বাড়ছে ব্যবসায়ী মহলেও।
এনবিআরের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠানের সামনে দাঁড়িয়ে এখন মুখোমুখি দুই পক্ষ—প্রশাসন বনাম কর্মচারী। সমাধান না হলে এর প্রভাব দেশের রাজস্ব খাতে মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



