
ছবি: সংগৃহীত
এক সময় টেলিভিশনের পর্দায় ঘরোয়া আবেগ, পারিবারিক টানাপোড়েন আর সমাজ বাস্তবতার নিখুঁত প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা হতো নাটকের মাধ্যমে। মা-ছেলের দূরত্ব, স্বামী-স্ত্রীর অভিমান, প্রেম-ভালোবাসার সহজ সরল গল্প কিংবা মধ্যবিত্ত জীবনের লড়াই—এইসবই ছিল টেলিভিশন নাটকের পরিচিত উপজীব্য। কিন্তু সময়ের স্রোতে গল্প বলার সেই ভাষা বদলেছে। এখন আর কেবল মাত্র টেলিভিশনের দিকে চেয়ে নেই দর্শক। পরিবর্তিত জীবনধারা ও প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে দর্শকদের বিনোদনের ধরনেও এসেছে নাটকীয় পরিবর্তন। আর এই পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে ওটিটি (OTT) প্ল্যাটফর্ম।
বর্তমানে দেশে হু-হু করে বাড়ছে ওটিটি কনটেন্টের জনপ্রিয়তা। দেশি ও আন্তর্জাতিক অনেক অ্যাপ-ভিত্তিক স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম যেমন বায়স্কোপ, চরকি, হইচই, সিনেস্পট, ক্লিক এইচডি, বিঞ্জ ইত্যাদিতে তৈরি হচ্ছে ওয়েব সিরিজ ও শর্টফিল্ম—যেগুলোর দর্শকসংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। কারণ, এখানে গল্পে আছে বৈচিত্র্য, সাহসিকতা, কারিগরি উৎকর্ষ এবং বাস্তবতার প্রতি দায়বদ্ধতা।
এক সময় ৩০ মিনিট বা ১ ঘণ্টার একক নাটক কিংবা ৫০-১০০ পর্বের ধারাবাহিক নাটক ছিল দর্শকের মূল বিনোদন। এখন সেসব নাটকে প্রায় একই ধাঁচের কমেডি, অতিনাটকীয়তা এবং বারবার পুনরাবৃত্ত গল্প দর্শকদের মধ্যে বিতৃষ্ণার জন্ম দিচ্ছে। এদিকে ওটিটি সিরিজগুলো সাধারণত ২০-৪০ মিনিট দৈর্ঘ্যের হয়ে থাকে এবং প্রতি সিজনে থাকে ৬ থেকে ১০ পর্ব। কাহিনিতে থাকে থ্রিলার, ডার্ক কমেডি, রাজনৈতিক রূপক, সামাজিক বাস্তবতা, সাসপেন্স ও মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন।
ওটিটিতে সাবস্ক্রিপশন ভিত্তিতে দর্শক টাকা দিয়ে কনটেন্ট দেখেন, ফলে নির্মাতাদের জন্য ‘বস্তুগত মান’ ধরে রাখা বাধ্যতামূলক। বাজেট থাকে তুলনামূলক ভালো, সময় নিয়ে কাজ করা যায় এবং সবচেয়ে বড় কথা, এখানে থাকে সৃজনশীল স্বাধীনতা।
নাট্যনির্মাতা ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, টিভি নাটক এখন একধরনের চাপে পড়ে কাজ করছে। সেখানে গল্প বলার স্বাধীনতা নেই। নির্মাণের সময় নেই, বাজেট নেই, কিন্তু প্রতিনিয়ত নাটক তৈরি করতে হয়। নাটক নির্মাণের সময় বিবেচনায় রাখতে হয় বিজ্ঞাপনদাতার চাহিদা, চ্যানেল কর্তৃপক্ষের নীতিমালা এবং টেলিভিশনের কাঁচি চালানো কমিটির রুচিবোধ। ফলে প্রোডাকশনের পুরো প্রক্রিয়াই যেন হয়ে দাঁড়ায় ‘দেনা শোধের কাজ’।
একজন নির্মাতা বলেন, “আমাদের বলা হয়—তিন দিনের মধ্যে নাটক বানিয়ে দাও। স্ক্রিপ্ট হাতে পাই শুটিংয়ের আগের রাতে। বাজেট কম, লোকবল কম, তবু নাটক বানাতে হয়। এই কাজ আর শিল্প থাকে না।”
ওটিটির আরেকটি বড় অর্জন হলো নতুন প্রজন্মের সৃজনশীলদের উঠে আসার প্ল্যাটফর্ম। যারা আগে টেলিভিশনের সীমাবদ্ধতায় কাজ করার সুযোগ পেতেন না, তারা এখন ওয়েবে নিজেদের মেলে ধরছেন। চিত্রনাট্যকার, নতুন পরিচালক, অভিনয়শিল্পী—সবার জন্য এটি হয়ে উঠেছে সম্ভাবনার নতুন ঠিকানা।
অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম বলেন, “ওটিটিতে কাজের পরিসর বেড়েছে। চরিত্রের গভীরতা আনা যায়। টিভি নাটকে এই সুযোগ কম। তবে, ভালো গল্প ও পর্যাপ্ত সময় পেলে টিভিতেও ভালো কাজ সম্ভব।”
অভিনেতা মোশাররফ করিম বলেন, “টিভি নাটকে এখন সময় নেই, ধৈর্য নেই। ওটিটিতে চরিত্র নিয়ে কাজ করার সুযোগ আছে। তবে সেন্সরের অভাবে কিছু নির্মাতা দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বাড়াবাড়ি করছেন। সেটাও শিল্পের ক্ষতি করে।”
অভিনেতা জাহিদ হাসান বলেন, “ওয়েব সিরিজ শহুরে দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় হতে পারে, কিন্তু দেশের বাইরের বিশাল দর্শকগোষ্ঠী এখনো টেলিভিশনের নাটক দেখে। তাই আমরা ভুলে গেলে চলবে না যে, দুই মাধ্যম দুই ধরনের দর্শককে সেবা দিচ্ছে।”
ওটিটির সাফল্যের পাশাপাশি বিতর্কও কম নেই। অতিরিক্ত যৌন ইঙ্গিত, ভাষা ও দৃশ্যপট নিয়ে দর্শকদের একাংশ আপত্তি তুলছেন। অনেকে বলছেন, ‘স্বাধীনতা’র নামে অনেক ক্ষেত্রেই শালীনতার সীমা লঙ্ঘিত হচ্ছে। ফলে এখন ওটিটি সেন্সর নীতিমালার দাবি উঠেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, “ওয়েব সিরিজ সাহসী হোক, কিন্তু সমাজ বিচ্যুত নয়। সাহসী গল্প বলার স্বাধীনতা থাকা উচিত, তবে তা যেন সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়। তা না হলে এই মাধ্যমও এক সময় দর্শক হারাবে।”
বিনোদনের এই পরিবর্তন কেবল প্রযুক্তি-নির্ভর নয়, এটি দর্শকের মনস্তত্ত্বেও পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবি। দর্শক এখন চায় গল্পের গভীরতা, চরিত্রের বৈচিত্র্য এবং নির্মাণের কারিগরি উৎকর্ষ। ওটিটি সেই চাহিদা পূরণ করছে। তবে টিভি নাটকের গুরুত্ব পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। পরিবারকেন্দ্রিক গল্প, দিবসভিত্তিক নাটক কিংবা জনপ্রিয় ধারাবাহিক এখনো টিভিতেই বেশি জনপ্রিয়।
তাই সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ওটিটি এবং টিভি নাটক একে অপরের প্রতিযোগী নয়, বরং পরিপূরক। নতুন ধারার ওয়েব সিরিজ ভবিষ্যতের নাট্যভাষা তৈরি করছে, আর টিভি নাটকের ঐতিহ্যিক ভিত্তি এখনো অনেকের মনে আবেগ ও আস্থা হিসেবে রয়ে গেছে।
অভিনেতা ও নির্মাতা আফজাল হোসেন বলেন, “নাটকের মাধ্যম বদলেছে, গল্প বলার দায় বদলায়নি। ওটিটিতে স্বাধীনতা আছে, কিন্তু সেই স্বাধীনতাকে শিল্পে রূপ দেওয়াটাই আসল চ্যালেঞ্জ। সমাজের দায়িত্ব ভুলে গেলে গল্প হিংস্র হয়ে ওঠে।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ