
ছবি: সংগৃহীত
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যা করার পরিকল্পনা ছিল ইসরাইলের—এমন বিস্ফোরক তথ্য দিয়েছেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাৎজ। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উপযুক্ত সুযোগ কখনোই তাদের সামনে আসেনি। কাৎজ বলেন, “আমরা চেয়েছিলাম খামেনিকে নির্মূল করতে, কিন্তু কার্যকর কোনো সুযোগ আমাদের হাতে ছিল না।” তার এই মন্তব্য যুদ্ধকালীন দুই দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনার নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছে।
বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) ইসরাইলি চ্যানেল ১৩-কে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে কাৎজ এসব মন্তব্য করেন। দীর্ঘ এই আলোচনায় তিনি সরাসরি ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা থাকার কথা বললেও দাবি করেন, তারা আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোর বাইরে গিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। “আমরা আমাদের নিরাপত্তা, আমাদের ভবিষ্যৎ এবং আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই এমন একটি পরিকল্পনা করেছিলাম,” যোগ করেন ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী।
সাক্ষাৎকারে কাৎজের কাছে জানতে চাওয়া হয়, ইরানের সর্বোচ্চ নেতার ওপর হামলার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতির প্রয়োজন ছিল কি না। জবাবে তিনি বলেন, “এসব ক্ষেত্রে আমাদের যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতির প্রয়োজন হয় না। আমরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারি, বিশেষ করে যদি সেটা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন হয়।”
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এমন স্পষ্ট বক্তব্য ও আক্রমণাত্মক কৌশল প্রকাশ করার পেছনে ইসরাইলের একটি কৌশলগত বার্তা রয়েছে। তা হলো—তারা ইরানকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করছে এবং প্রয়োজনে তাদের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধেও সরাসরি হামলায় যেতে পারে।
একইদিন, ইসরাইলের এই মন্তব্যের কয়েক ঘণ্টা পরই জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন আয়াতুল্লাহ খামেনি। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি এখনো যুদ্ধকালীন নিরাপদ স্থানে অবস্থান করছেন এবং সেখান থেকেই তিনি ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্দেশ করে কঠোর বার্তা দিয়েছেন।
ভাষণে খামেনি বলেন, “ভুয়া ইহুদিবাদী সরকারকে আমরা যুদ্ধে পরাজিত করেছি। তারা আমাদের ভেঙে ফেলতে পারেনি, বরং নিজেরাই ভেঙে পড়েছে।”
তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দিকেও কটাক্ষ করে বলেন, “ইরান তাদের মুখে থাপ্পড় মেরেছে।” বিশ্লেষকদের মতে, খামেনির এই বক্তব্য শুধু প্রতিরোধের বার্তা নয়, বরং ইসরাইলের সরাসরি হত্যার পরিকল্পনার জবাব হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।
উল্লেখ্য, গাজায় হামাসের হামলার জেরে অক্টোবর ২০২৩ থেকে ইসরাইল-ইরান সংঘাত নতুন মাত্রা পায়। ইসরাইলের দাবি, ইরান সরাসরি হামাস ও হিজবুল্লাহকে অস্ত্র, অর্থ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধ সক্ষম করে তুলছে। ফলে ইসরাইল একে কেবল গাজার বিরুদ্ধে নয়, বরং একটি আঞ্চলিক লড়াই হিসেবে দেখছে।
এদিকে ইরান বলছে, তাদের ভূখণ্ডে হামলা হলে তারা পূর্ণ শক্তি দিয়ে জবাব দেবে। বাস্তবে এই যুদ্ধ ইতোমধ্যেই সরাসরি ইরান-ইসরাইল সংঘাতে রূপ নিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহল মনে করছে, ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী কাৎজের এই স্বীকারোক্তি ভবিষ্যতে আরও উত্তেজনার জন্ম দিতে পারে। ইরান এমনিতেই নিজের ভূখণ্ডের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, তার উপর খামেনির প্রাণনাশের পরিকল্পনার মতো হুমকি উচ্চারণ—তাদের প্রতিরোধ নীতিকে আরও আক্রমণাত্মক করে তুলতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের অন্যতম বিতর্কিত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব আয়াতুল্লাহ খামেনিকে হত্যার মতো পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিরাট প্রভাব ফেলতে পারে। এটি শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, বরং পুরো মুসলিম বিশ্বকে ক্ষুব্ধ করে তুলতে পারে।
ইসরাইলের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে ইরানের শীর্ষ নেতাকে হত্যার পরিকল্পনার কথা বলা এক নজিরবিহীন ঘটনা। খামেনির পাল্টা বক্তব্য এবং দুই দেশের যুদ্ধকালীন অবস্থান, ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যে আরও অস্থিরতা তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ইরান-ইসরাইল সংঘাত এখন আর সীমিত নয়—এটি আঞ্চলিক নেতৃত্ব, ভূরাজনৈতিক প্রভাব এবং আন্তর্জাতিক সহিংসতার এক নতুন পর্বে প্রবেশ করেছে। আর এই অবস্থায় দুই দেশের উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্ব যদি সরাসরি টার্গেট হয়, তাহলে পরিস্থিতি অনিয়ন্ত্রিত হওয়ার আশঙ্কা আরও প্রবল।
সূত্র: টাইমস অব ইসরাইল, চ্যানেল ১৩, রয়টার্স
বাংলাবার্তা/এমএইচ