
ছবি: সংগৃহীত
চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কুনমিং বৈঠক ঘিরে আন্তর্জাতিক মহলে যেভাবে আলোচনার ঝড় উঠেছে, তাতে বিষয়টি যেন অকারণে অতিমাত্রায় রাজনৈতিক রূপ নিয়েছে। বৈঠকটি নিয়ে অনেকেই এটিকে ‘নতুন জোট গঠনের সূচনা’ কিংবা ‘ভারতবিরোধী উদ্যোগ’ বলে ব্যাখ্যা করছেন। তবে এসব গুঞ্জন ও অনুমান ভিত্তিহীন বলে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিল বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বৃহস্পতিবার বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সামনে পরিষ্কার ভাষায় বলেন—বাংলাদেশ এই বৈঠকের মাধ্যমে কোনো জোট গঠন করছে না, বরং এটি ছিল একেবারেই একটি সীমিত পর্যায়ের, আমলাতান্ত্রিক ও বাস্তবভিত্তিক যোগাযোগ ও বাণিজ্য বিষয়ে আলোচনা।
চীনের কুনমিং শহরে আয়োজিত প্রদর্শনী উপলক্ষে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এখানে চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবরা একত্রে বসেন এবং আলোচনার মূখ্য বিষয় ছিল কানেক্টিভিটি, আঞ্চলিক বাণিজ্য, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং পারস্পরিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সহযোগিতা।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “এটি কোনো রাজনৈতিক পর্যায়ের বৈঠক ছিল না। এই আলোচনা ছিল পুরোপুরি কর্মকর্তা পর্যায়ে। চীন থেকে এমন একটি আমন্ত্রণ এসেছিল, যেখানে একটি এক্সিবিশনের সময় বিভিন্ন দেশের আমলারা বৈঠকে মিলিত হন এবং স্বাভাবিকভাবেই পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়ে কথা বলেন।”
তিনি বলেন, “কোনো ধরনের জোট গঠনের পরিকল্পনা কিংবা আলোচনা সেখানে হয়নি। এটিকে অকারণে অতিরঞ্জিত করে দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। এটি নিছকই বাস্তব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আলোচনা ছিল। এর বাইরে কোনো বিশেষ কৌশলগত উদ্দেশ্য ছিল না।”
চীন যেখানে এই বৈঠককে বলছে ‘ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা’, পাকিস্তান বলছে ‘ত্রিপক্ষীয় মেকানিজম’—সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ এই দুটি পরিভাষাকেই প্রত্যাখ্যান করছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তৌহিদ হোসেন বলেন, “অস্বীকার করার কিছু নেই। বিষয়টি কাঠামোগত কোনো আয়োজন ছিল না। প্রত্যেকেই তাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে। আমরাও আমাদের বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিয়েই দেখছি।”
তিনি আরও বলেন, “এই ধরনের বৈঠকে ভবিষ্যতে কোনো কাঠামো তৈরি হলে, তা সময়মতো সবাইকে জানানো হবে। তবে বর্তমান আলোচনাকে রাজনৈতিক জোট বা মেকানিজম হিসেবে আখ্যা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”
বৈঠকটি ভারতবিরোধী কি না—এই প্রশ্ন ঘিরেও চলছে জল্পনা। তবে এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্য অত্যন্ত পরিস্কার। তিনি বলেন, “আমরা কখনোই তৃতীয় কোনো পক্ষকে টার্গেট করে এমন উদ্যোগ নিইনি। ভবিষ্যতেও নেব না। যদি ভারত চায়, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভারত মিলে কোনো আলোচনা করে, কানেক্টিভিটি বা পরিবহন বিষয়ে—আমি কালকেই সে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত।”
তার বক্তব্যে বোঝা যায়, বাংলাদেশ কোনও আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা বা ক্ষমতার ভারসাম্যের খেলায় অংশ নিতে চায় না। বরং দেশটি নিজের অবস্থানকে একটি নিরপেক্ষ, বাস্তববাদী ও ব্যবসা-বান্ধব ভূরাজনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে পরিচালনা করতে চায়।
তৌহিদ হোসেন স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “এই বৈঠক নিয়ে অতিরিক্ত আলোচনা হচ্ছে শুধু এই কারণে যে, এখানে তিনটি দেশ একসঙ্গে এসেছে এবং এর মধ্যে দুটি দেশ—চীন ও পাকিস্তান—বিভিন্ন কৌশলগত ক্ষেত্রে একে অপরের ঘনিষ্ঠ। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, বাংলাদেশও কোনো রাজনৈতিক মেরুকরণে যাচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “সাংবাদিকদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, বিষয়টিকে রাজনৈতিক চোখে না দেখে বাস্তব প্রয়োজন ও পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিশ্লেষণ করুন। এতে জল্পনা-কল্পনা কমবে এবং সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হবে না।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ পূর্বেও এ ধরনের ত্রিপক্ষীয় বা দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নিয়েছে। বিশেষ করে চীন, ভারত, নেপাল, ভুটান এমনকি মিয়ানমারের সঙ্গেও আঞ্চলিক যোগাযোগ ও বাণিজ্য সংক্রান্ত নানা পর্যায়ে আলোচনা চালিয়েছে। কিন্তু এবারের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকটি বেশি আলোচিত হয়েছে মূলত ভারত-চীন ও পাকিস্তান-ভারত বিরোধপূর্ণ সম্পর্কের প্রেক্ষিতে।
তবে বাংলাদেশ শুরু থেকেই বলে আসছে—তারা কাউকে বাদ দিয়ে, কাউকে কেন্দ্র করে বা কাউকে চাপে ফেলে কোনও উদ্যোগে যেতে চায় না। বরং আঞ্চলিক শান্তি, স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়ে সব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করতে চায়।
সর্বশেষ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত কুনমিং বৈঠক কোনো জোট গঠনের পদক্ষেপ নয়, বরং আঞ্চলিক সহযোগিতা ও বাস্তব বিষয়াদির ওপর একটি সাধারণ বৈঠক মাত্র।
এটি রাজনৈতিক বা কৌশলগত মেরুকরণের অংশ হিসেবে দেখা ভুল হবে। বরং এটি একটি নিছক সচেতন আমলাতান্ত্রিক উদ্যোগ, যেখানে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সংযোগ বৃদ্ধির বিষয়েই মূলত আলোচনা হয়েছে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বরাবরই ‘বন্ধুত্ব সবার সঙ্গে, শত্রুতা কারও সঙ্গে নয়’—এই নীতির আলোকে পরিচালিত হয়ে আসছে। তাই এই বৈঠককে ঘিরে কোনো প্রকার রাজনৈতিক বিভ্রান্তি বা অমূলক আশঙ্কা তৈরি না করাই যুক্তিযুক্ত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ