
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) দেশের রাজনৈতিক সংকট নিরসন এবং ভবিষ্যতের রূপান্তরমূলক পরিবর্তন নিশ্চিত করতে যে ৩১ দফা সংস্কারের রূপরেখা দিয়েছে, তা বাস্তবায়নে দলটি এককভাবে নয়, বরং সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবেই এগোতে চায়। বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে এই অবস্থান স্পষ্ট করেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
বৈঠকে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নির্বাচনকালীন সরকার, ৩১ দফা রূপরেখা এবং আন্দোলনের ভবিষ্যৎ রূপরেখা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ সময় দুই দলের নেতারাই গত কয়েক মাসের রাজনৈতিক বাস্তবতা, ভবিষ্যৎ লক্ষ্য এবং লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আলোচিত বৈঠক নিয়েও মতবিনিময় করেন।
বৈঠক শেষে আমির খসরু সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা সবাই মিলে আন্দোলনে ছিলাম, সংগ্রামে ছিলাম, ত্যাগ করেছি। ভবিষ্যতেও সম্মিলিতভাবে পথ চলতে চাই। নির্বাচনের আগে, পরে এবং দীর্ঘ মেয়াদে যে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কার দরকার, তার একটি রূপরেখা হিসেবে ৩১ দফা আমাদের জাতীয় দলিল। একে বাস্তবায়ন করতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবেই।”
তিনি বলেন, “আমাদের আলোচনার একটি বড় অংশজুড়ে ছিল—আগামীতে নির্বাচন এবং নির্বাচন-পরবর্তী বাংলাদেশ কেমন হবে? আমরা চাচ্ছি, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, ভোটাধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যেসব মৌলিক সংস্কার দরকার, তা সকল মিত্র দল ও জোটের সঙ্গে একত্রে বাস্তবায়ন করতে।”
বৈঠকের একপর্যায়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আমির খসরু বলেন, “ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের একটা সময়সীমা আসছে। সেই আলোর রেখার দিকেই আমরা এগোচ্ছি। এই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমন্বয় এবং প্রস্তুতির বিষয়গুলো আলোচনায় এসেছে।”
তিনি বলেন, “নির্বাচনের আগে আন্দোলনের রূপরেখা, গণতান্ত্রিক দাবিগুলো পুনরুজ্জীবিত করা এবং নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে জনগণের ম্যান্ডেট বাস্তবায়নের বিষয়গুলো ঘিরেই আমাদের মতবিনিময় হয়েছে।”
বৈঠকে তারেক রহমান ও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যকার সাম্প্রতিক বৈঠক নিয়েও আলোচনা হয়। আমির খসরু বলেন, “লন্ডনে যে আলোচনা হয়েছে, সেটা আমরা সমমনা দলের সঙ্গে শেয়ার করেছি। এর মাধ্যমে সিদ্ধান্তগুলো আরও গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক হয়।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের নেতারা সবসময় চেষ্টা করেন—আন্দোলনের দীর্ঘকালের সঙ্গীদের সঙ্গে প্রতিটি অগ্রগতি ভাগাভাগি করে নিতে। কারণ এটি কেবল বিএনপির একক পথ নয়—এটি একটি জাতীয় প্রয়াস।”
৩১ দফা রূপরেখা নিয়ে বিতর্কের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আমির খসরু বলেন, “এ নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যেমন বলছেন, তেমনি তারেক রহমানও পরিষ্কার করে বলেছেন—যে কটি মৌলিক সংস্কার সম্ভব, সেগুলোতেই রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তোলা হয়েছে। এর বাইরে গিয়ে কোনোকিছু করার প্রয়োজনও নেই, সুযোগও নেই।”
তিনি উল্লেখ করেন, “বর্তমান রাষ্ট্র কাঠামো জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন নয়। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক দমন-পীড়ন ও দুর্নীতি থেকে উত্তরণের জন্য বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে সংস্কার আবশ্যক।”
বিএনপির তরফ থেকে আসন্ন স্থানীয় সরকারের নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমির খসরু বলেন, “ইশরাক হোসেনের বিষয়ে আদালতের রায় সুস্পষ্ট। তাকে মেয়র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনও তার দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়টি অনুমোদন দিয়েছে। আমরা সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। আইন অনুযায়ী তিনি দায়িত্ব নিতে পারবেন।”
বৈঠকে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান বলেন, “আমরা সবসময় জনগণের স্বার্থ ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনে ছিলাম। বিএনপির ৩১ দফা বাস্তবায়ন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারে ঐকমত্যে আছি। নতুন বাংলাদেশ গঠনের এই যাত্রায় আমরা পাশে আছি, থাকব।”
ফারুক হাসান বলেন, “আমরা চাই একটি যুগোপযোগী রাষ্ট্র ব্যবস্থা, যেখানে তরুণ-যুবকদের সুযোগ থাকবে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। এজন্য ঐক্যবদ্ধ রাজনীতিই একমাত্র পথ।”
বিএনপির পক্ষ থেকে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এবং ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু। অপরদিকে গণঅধিকার পরিষদ থেকে অংশ নেন—সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান, সিনিয়র সহ-সভাপতি ফারুক হাসান, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসান আল মামুন, খালিদ হোসেন ও হাবিবুর রহমান রিজু।
সার্বিকভাবে, বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর এই বৈঠক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় একটি ঐক্যবদ্ধ কৌশলের দিকে অগ্রসর হওয়ার সংকেত দিচ্ছে। যে সংস্কার রূপরেখা নিয়ে নানা মহলে আলোচনা-সমালোচনা চলছে, তার মৌলিক ভিত্তি এখন ‘সম্মিলিত প্রয়াস’ এবং গণআন্দোলনের চেতনার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের পথেই এগোচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কেমন হবে—তার একটা রূপরেখা তৈরি হচ্ছে, যার কেন্দ্রে আছে ৩১ দফা। এখন দেখার বিষয়—এই ঐকমত্য কতটা কার্যকরভাবে রূপ পায় ভবিষ্যতের রাজনীতিতে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ