
ছবি: সংগৃহীত
গাজার আকাশে আবারও মৃত্যু নামিয়ে এনেছে ইসরাইলি বাহিনী। টানা হামলার নতুন পর্বে মাত্র ২৪ ঘণ্টায় প্রাণ হারিয়েছেন আরও অন্তত ৭১ জন ফিলিস্তিনি। আহত হয়েছেন অগণিত মানুষ। এ ঘটনায় বিশ্বজুড়ে তীব্র উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়লেও থেমে নেই হামলার তাণ্ডব। অধিকাংশ হতাহতই নারী ও শিশু বলে নিশ্চিত করেছে স্থানীয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
শুক্রবার (২৭ জুন) কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার সরাসরি সম্প্রচারে এসব ভয়াবহ তথ্য উঠে আসে। ফিলিস্তিনের গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, গত এক দিনে সংঘটিত এই হতাহতের ঘটনা চলমান দমন-পীড়নেরই অংশ। ইসরাইলি বাহিনীর বিমান, ড্রোন ও কামান হামলায় প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে গাজার আবাসিক এলাকা, ত্রাণ কেন্দ্র ও বাজারগুলো।
সবচেয়ে হৃদয়বিদারক চিত্রটি উঠে এসেছে বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের পরিচালিত সহায়তাকেন্দ্রগুলোর পরিস্থিতিতে। গাজা সরকার জানিয়েছে, গত এক মাসে এই সহায়তাকেন্দ্রগুলোতে নিহত হয়েছেন অন্তত ৫৪৯ জন ফিলিস্তিনি। নিহতদের অনেকেই ছিলেন খাদ্য সহায়তা পেতে অপেক্ষারত। ক্ষুধার্ত জনগণের জন্য আশার স্থান হিসেবে পরিচিত এসব কেন্দ্র এখন রূপ নিয়েছে 'মৃত্যুর ফাঁদে'—এমনটাই বলছে সংশ্লিষ্ট ত্রাণ সংস্থাগুলো। তাদের মতে, এখনো নিখোঁজ রয়েছেন আরও অন্তত ৩৯ জন।
একইদিনে আগের হামলায় প্রাণ হারান আরও অন্তত ৭৯ জন। ফলে গাজায় প্রতিদিনই বাড়ছে লাশের সারি। হাসপাতালগুলোতেও দেখা দিয়েছে তীব্র সংকট। চিকিৎসাসেবা ও ওষুধের ঘাটতির কারণে অনেক আহতকে বাঁচানো যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
অন্যদিকে গাজায় মানবিক সহায়তা কার্যক্রম বন্ধে ফের কঠোর অবস্থানে গেছেন ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির। বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) তিনি ঘোষণা দেন, গাজায় মানবিক সহায়তা পাঠানো 'ইসরাইলের জন্য লজ্জাজনক' কাজ। তার ভাষায়, যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুদের প্রতি দয়া দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই।
এই বক্তব্যের পরপরই ইসরাইল দুই দিনের জন্য গাজায় সব ধরনের সহায়তা সরবরাহ বন্ধ ঘোষণা করে। বন্ধ করে দেয় উত্তর গাজামুখী সহায়তা করিডোরগুলোও। এতে করে খাবার ও ওষুধের চরম সংকটে পড়েছে লাখো মানুষ। জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, এই পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হলে দুর্ভিক্ষে প্রাণহানি আরও ব্যাপক হতে পারে।
অন্যদিকে গাজায় হামাসের হাতে আটক ইসরাইলি জিম্মিদের মুক্তির দাবিতে বৃহস্পতিবার তেল আবিবে বড় ধরনের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। জিম্মিদের পরিবারের সদস্যরা এই বিক্ষোভে অংশ নিয়ে যুদ্ধ অবসানের আহ্বান জানান। তারা অভিযোগ করেন, রাজনৈতিক স্বার্থে জিম্মিদের জীবন বিপন্ন করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরাইল সরকারকে এই ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আহ্বান জানান তারা।
প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজার স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস ইসরাইলে অভাবনীয় হামলা চালায়। এতে প্রায় ১২০০ জন ইসরাইলি নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেই ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে ইসরাইল গাজার উপর অসামান্য আগ্রাসন চালিয়ে আসছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্যমতে, অক্টোবরের পর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরাইলি হামলায় ৫৬ হাজার ২৫৯ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ১ লাখ ৩২ হাজার ৪৫৮ জন। আক্রান্তদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশই শিশু, নারী ও বয়োবৃদ্ধ।
এ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ একাধিক সংস্থা বলছে, গাজায় ইসরাইলের আক্রমণ যুদ্ধাপরাধের শামিল। তারা যুদ্ধবিরতির জন্য জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরাইল যে কৌশলে ত্রাণ কেন্দ্রগুলোকেও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে, তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের জ্বলন্ত উদাহরণ। জাতিসংঘের এক মুখপাত্র বলেন, “গাজা এখন পৃথিবীর অন্যতম বিপজ্জনক স্থান। যেখানে প্রতিটি ঘণ্টায় মানুষ মারা যাচ্ছে—ক্ষুধায়, আক্রমণে, কিংবা চিকিৎসার অভাবে।”
বর্তমানে গাজা যেন মৃত্যু ও ধ্বংসের প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে যুদ্ধ, অন্যদিকে খাদ্য, পানি, চিকিৎসা ও আশ্রয়ের সংকট—সব মিলিয়ে লাখো মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। নিহতদের পরিসংখ্যানই শুধু নয়, বাস্তবিক দিক থেকে এই যুদ্ধ প্রতিটি ফিলিস্তিনি পরিবারকে শোক, বেদনা ও অনিশ্চয়তার অতল গহ্বরে ঠেলে দিয়েছে।
যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই—থামছে না মৃতের মিছিলও।
বাংলাবার্তা/এমএইচ