
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বিভিন্ন ইস্যুতে ভারত সবসময় আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে বিশ্বাসী—এমন বার্তা দিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল। শুক্রবার (২৭ জুন) ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত সাপ্তাহিক সংবাদ সম্মেলনে তিনি একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ভারতের অবস্থান তুলে ধরেন। এতে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক, নদীর পানি বণ্টন, বাণিজ্যিক সমঝোতা, সংখ্যালঘু নিরাপত্তা এবং চীন-পাকিস্তান-বাংলাদেশ ত্রিপক্ষীয় বৈঠক প্রসঙ্গে খোলামেলা মন্তব্য করেন এই মুখপাত্র।
গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি নবায়ন নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে রণধীর জয়সওয়াল বলেন, “বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সুদীর্ঘ ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আমরা একে অপরের সঙ্গে ৫৪টি নদীর পানি ভাগাভাগি করি। তাই পানি ইস্যুতে যৌথ আলোচনার গুরুত্ব অপরিসীম।” তিনি আরও বলেন, “এই উদ্দেশ্যে আমাদের যৌথ নদী কমিশন (Joint Rivers Commission-JRC) রয়েছে। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমেই দুই দেশ নিয়মিত আলোচনা করে থাকে এবং ভবিষ্যতেও এই আলোচনা অব্যাহত থাকবে।”
রণধীর স্পষ্ট করে বলেন, “ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সব বিষয়ে আলোচনায় প্রস্তুত—শুধু পানি নয়, যেকোনো পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুতেই আমরা খোলামেলা আলোচনায় বিশ্বাস করি। কিন্তু সেই আলোচনার জন্য প্রয়োজন অনুকূল ও পারস্পরিক আস্থাভিত্তিক পরিবেশ।”
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বাণিজ্যিক চুক্তি ও নীতিগত সমঝোতা নিয়েও মুখ খোলেন জয়সওয়াল। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি ন্যায়সঙ্গত, সমমর্যাদাপূর্ণ এবং পারস্পরিক চাওয়ার ভিত্তিতে বাণিজ্যিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। আমরা এটিকে স্বাগত জানাই।”
তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এখনও অগ্রগতি না হওয়ায় হতাশাও প্রকাশ করেন তিনি। “ভারত একাধিকবার সচিব পর্যায়ের বৈঠকসহ উচ্চপর্যায়ে গঠনমূলক আলোচনা করেছে। এখন আমরা আশা করছি, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে দ্রুত সমাধান আসবে। কারণ কিছু বিষয় বহুদিন ধরে ঝুলে আছে, যা দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের অগ্রগতিতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে,” বলেন রণধীর।
সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার খিলক্ষেত এলাকায় একটি দুর্গা মন্দির ভেঙে দেওয়ার ঘটনায় ভারত গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। রণধীর বলেন, “আমরা জানতে পেরেছি, কিছু কট্টরপন্থি ব্যক্তি মন্দির ভাঙার দাবি তুলেছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেই মন্দিরের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে বরং ‘অবৈধ জমি’ ব্যবহারের অজুহাতে সেটি ভাঙার অনুমতি দিয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও তাদের উপাসনালয় রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের। বারবার এ ধরনের ঘটনা শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘনের উদাহরণ নয়, বরং পারস্পরিক আস্থারও ক্ষতি করছে।”
সম্প্রতি চীনের কুনমিং শহরে চীন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিবদের মধ্যে অনুষ্ঠিত একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠকও ভারতীয় সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ প্রসঙ্গে মুখপাত্র বলেন, “আমরা প্রতিবেশী অঞ্চলের প্রতিটি ঘটনার ওপর নিবিড় নজর রাখি। কারণ, এসব ঘটনাপ্রবাহ আমাদের নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক স্বার্থের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।”
তবে তিনি নিশ্চিত করেন, “আমাদের প্রতিটি দেশের সঙ্গে আলাদা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রয়েছে, যা আমাদের নিজস্ব অবস্থানের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। আমরা সেগুলোকেই মূল্যায়ন করি এবং বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিই।”
পুরো ব্রিফিং জুড়ে রণধীর জয়সওয়ালের বক্তব্যে স্পষ্ট ছিল যে, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে কৌশলগত, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করে।
তিনি বলেন, “আশা করি, বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ ও সহযোগিতার ধারা অব্যাহত থাকবে। আলোচনার দরজা সবসময় খোলা রয়েছে।”
বিশ্লেষকদের মতে, জয়সওয়ালের বক্তব্যে ভারত বাংলাদেশের প্রতি একদিকে যেমন বন্ধুত্বের বার্তা দিয়েছে, অন্যদিকে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে কঠোর অবস্থানও জানিয়েছে। বিশেষ করে সংখ্যালঘু নিরাপত্তা এবং তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে ভারতের চিন্তা-ভাবনা আগের তুলনায় আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আগামী দিনে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক স্তরে আরও ঘনিষ্ঠ আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ