
ছবি: সংগৃহীত
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ছিনতাই, খুন, চাঁদাবাজি, চুরি-ডাকাতি, অপহরণ, ধর্ষণসহ নানা অপরাধের পারদ ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী। সশস্ত্র ছিনতাইকারীদের প্রকাশ্যে দৌরাত্ম্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা, এবং অপরাধ দমনে সরকারের উদ্যোগের সীমাবদ্ধতা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, রাজধানীর ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর এলাকায় পথচারীর ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার পর হাতে চাপাতি নিয়ে নির্বিঘ্নে রাস্তায় হাঁটে এক ছিনতাইকারী। ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের দুই সদস্য ছিলেন নির্বিকার। ঘটনা ঘটে বৃহস্পতিবার রাতে। কিন্তু রোববার ভিডিওটি ভাইরাল হলে তীব্র প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের দৃশ্য শুধুই আইনের শিথিল প্রয়োগ নয়, বরং এটি দেশের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দুর্বলতার নগ্ন প্রকাশ।
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দেশে খুনের মামলা হয়েছে ১ হাজার ৯৩৩টি। এই সংখ্যা ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রতি ছয় মাসে গড়ে খুনের মামলার চেয়ে অনেক বেশি।
জানুয়ারিতে খুনের মামলা: ২৯৪
ফেব্রুয়ারিতে: ৩০০
মার্চে: ৩১৬
এপ্রিল: ৩৩৮
মে: ৩৪১
জুনে: ৩৪৪
এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে ২০২৫ সাল হবে খুনের দিক থেকে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ বছর।
পাশাপাশি গত ৬ মাসে অপহরণের মামলা হয়েছে ৫১৭টি, যা গত কয়েক বছরের গড় হারকে ছাড়িয়ে গেছে। ডাকাতির মামলাও ৬ মাসে হয়েছে ৩৬৭টি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যরাও নিরাপদ নন। চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় ৩২৯টি মামলা হয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ সংখ্যা ২০২৩ সালেও ছিল ৬৪২টি। প্রতি বছরই পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা বাড়ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, “গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষায়। অথচ তারা এখনো রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এটা আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “পুলিশ বাহিনীর ওপর জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে সরকারের জোরালো পদক্ষেপ দরকার। পুলিশের মনোবল ভেঙে গেলে অপরাধীরা চাঙ্গা হয়।”
রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বিশেষ বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী দাবি করেছেন, “সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক ভালো।”
কিন্তু অপরাধের বাস্তব চিত্র এবং মাঠপর্যায়ে মানুষের অভিজ্ঞতা বলছে ভিন্ন কথা।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক আশরাফুল হুদা বলেন, “৩৬ জুলাইয়ের ঘটনার পর পুলিশের মনোবল ভেঙে গেছে। এই সুযোগে অপরাধীরা মাঠে নেমেছে। কিন্তু এদের দমন করতে হলে পুলিশের পাশাপাশি প্রশাসনকেও দায়িত্ব নিতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “গোপালগঞ্জের ঘটনার মতো ব্যর্থতা স্বীকার না করে অস্বীকার করলেই আইনশৃঙ্খলা ভালো থাকবে না। যেসব কর্মকর্তার ব্যর্থতা রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।”
অনেক বিশ্লেষক আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পেছনে রাজনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর হাত রয়েছে। উদ্দেশ্য হলো সরকারকে বেকায়দায় ফেলা এবং নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ তৈরি করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, “ডেভিল হান্টে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাদের পরে আবার অপরাধ বাড়লে প্রশ্ন আসে, তারা অপরাধ করছিল না কেন? তাহলে কি এখন যারা অপরাধ করছে তারা নতুন ডেভিল?”
তিনি আরও বলেন, “চিরুনি অভিযান, ডেভিল হান্ট—এসব শব্দ যতই শোনা যাক না কেন, সমন্বয় ছাড়া কোনো অভিযান কার্যকর হয় না। সরকারের উচিত সুশৃঙ্খল ও টেকসই নিরাপত্তা নীতি গ্রহণ করা।”
খুনের ঘটনায় সাধারণত মামলা হলেও, ছিনতাই বা চাঁদাবাজির মতো অপরাধে অনেকেই মামলা করতে ভয় পান বা থানায় গেলে অভিযোগ নিয়েই বিদায় দেওয়া হয়। এই চিত্রও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বড় প্রতিবন্ধক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী বলেন, “ফার্মগেট এলাকায় আমার মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়া হয়। থানায় গেলে বলে—আপনারা মামলা করে কি হবে? ফোন কি আর পাবেন?”
বিশেষজ্ঞদের মতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কেবল পুলিশের দায়িত্ব নয়; এটি প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সম্মিলিত দায়িত্ব।
অপরাধ দমনে নিরপেক্ষতা
পুলিশ বাহিনীর মনোবল পুনর্গঠন
গোয়েন্দা তথ্যের যথাযথ ব্যবহার
ভুক্তভোগীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে মামলা গ্রহণ
রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় বন্ধ
এই পদক্ষেপগুলো ছাড়া শুধু অভিযানের নামে অভিযান চালিয়ে অপরাধ কমানো সম্ভব নয়।
নাগরিকদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পেলে, রাষ্ট্রের প্রতি তাদের আস্থাও দিনে দিনে ক্ষয় হতে থাকবে—এ হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন দেশের শীর্ষ অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ