
ছবি: সংগৃহীত
গোপালগঞ্জে সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে তিন দিন কারফিউ কার্যকর রাখার পর ফের ১৪৪ ধারা জারি করেছে জেলা প্রশাসন। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) এক পথসভাকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া এই উত্তেজনার রেশ এখনও কাটেনি, যার ফলে জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রশাসন বারবার কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হচ্ছে।
শনিবার (১৯ জুলাই) রাত সাড়ে ১১টার দিকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক মুহম্মদ কামরুজ্জামান এক জরুরি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়ে দেন, রোববার সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত গোপালগঞ্জ জেলায় ১৪৪ ধারা বলবৎ থাকবে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও জনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে এবং জনগণের জানমালের নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় এনে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”
গোপালগঞ্জে এনসিপির পথসভাকে ঘিরে ১৬ জুলাই শুরু হয় দফায় দফায় সহিংসতা, ককটেল বিস্ফোরণ, অগ্নিসংযোগ ও সশস্ত্র হামলার ঘটনা। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে ১৪৪ ধারা এবং পরে সরাসরি কারফিউ জারি করা হয়।
সেদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে জেলায় কঠোর কারফিউ কার্যকর করা হয়। পরদিন, বৃহস্পতিবার, প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঢাকা বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত এক ব্রিফিংয়ে ঘোষণা আসে, কারফিউর মেয়াদ বাড়িয়ে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত করা হবে।
তবে শুক্রবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত মাত্র তিন ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হয়, যাতে স্থানীয় মানুষ বাজার-সদাই ও জরুরি প্রয়োজন মেটাতে পারেন।
শুক্রবার সন্ধ্যায় দ্বিতীয় দফায় ফের কারফিউ বাড়ানো হয় শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত। শনিবারেও পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়ায় আবার ঘোষণা আসে, শনিবার রাত ৮টা থেকে রোববার সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ থাকবে।
এই তিন দিনের মধ্যে শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর টহল, রাস্তায় ছিল বিজিবি, পুলিশ ও র্যাবের যৌথ চেকপোস্ট ও নজরদারি। যান চলাচল ও জনসমাগম ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, বন্ধ ছিল দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
জেলা প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “বর্তমানে গোপালগঞ্জে পরিস্থিতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এখনো থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্কতায় আছে, যাতে কোনও উসকানি বা সংঘর্ষের পুনরাবৃত্তি না ঘটে।”
প্রশাসনের তরফে বলা হয়েছে, গোপালগঞ্জের সার্বিক পরিস্থিতি, স্থানীয় নেতৃত্বের প্রতিক্রিয়া এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সুপারিশের ভিত্তিতে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ১৪৪ ধারা কতদিন থাকবে কিংবা আবার কারফিউ কার্যকর হবে কি না—তা নির্ভর করবে পরিস্থিতির ওপর।
প্রসঙ্গত, গত ১৬ জুলাই জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গোপালগঞ্জ শহরের কেন্দ্রস্থলে এক পথসভা আয়োজন করে। তবে অনুমতি ছাড়া এই সভা আয়োজন, উস্কানিমূলক বক্তব্য, মিছিল এবং পাল্টা প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে শহরের বিভিন্ন এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
দফায় দফায় সংঘর্ষের পাশাপাশি বিস্ফোরণ ঘটে কয়েকটি ককটেল, ভাঙচুর হয় দোকানপাট, ব্যক্তিগত গাড়ি ও সরকারি স্থাপনা। অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে শহরের দক্ষিণাংশে, যা পুরো পরিস্থিতিকে এক ভয়াবহ রূপ দেয়।
এই পরিস্থিতির জেরে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দ্রুত ১৪৪ ধারা জারি করেন, এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে কারফিউ কার্যকর হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মোতায়েন করা হয় বিজিবি, র্যাব, ডিবি ও সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী।
এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা দাবি করেছেন, “এটি একটি শান্তিপূর্ণ পথসভা ছিল, কিন্তু প্রশাসন অনুমতি না দিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছে।” অন্যদিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সাধারণ মানুষ এনসিপির কর্মকাণ্ডকে ‘উসকানিমূলক’ ও ‘সন্ত্রাসের সামিল’ বলে অভিযোগ করেছেন।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা না দিলেও, গোপন তদন্ত ও নজরদারি চলছে বলে সূত্র জানায়।
গোপালগঞ্জের সাম্প্রতিক অস্থিরতা আবারও প্রমাণ করে, রাজনৈতিক বা সামাজিক যে কোনো কর্মসূচি যদি সঠিকভাবে পরিচালিত না হয়, তবে তা নাগরিক জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
একটি পথসভাকে কেন্দ্র করে এমন সহিংসতার ঘটনায় জেলা প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা যেমন প্রশংসনীয়, তেমনি রাজনৈতিক সচেতনতাও জরুরি হয়ে উঠেছে।
বর্তমানে ১৪৪ ধারা বলবৎ থাকলেও, পরিস্থিতি উন্নতি না হলে প্রশাসন আবারও কারফিউসহ আরও কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে—এমন সতর্ক বার্তাও দিয়েছেন স্থানীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা।
গোপালগঞ্জবাসীর প্রত্যাশা, খুব দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশে তারা আবার ফিরে যেতে পারবেন স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ