
ছবি: সংগৃহীত
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অব্যাহত আগ্রাসন এবার এমন এক নিষ্ঠুর পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে ত্রাণের আশায় লাইনে দাঁড়ানো, নিরস্ত্র ও ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের উপর দিনদুপুরে স্নাইপার রাইফেল ও ট্যাংক ব্যবহার করা হচ্ছে। গুলিবিদ্ধ হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় পথেই লুটিয়ে পড়ছেন বহু মানুষ, যাদের একমাত্র ‘অপরাধ’ ছিল—এক ব্যাগ খাবার বা এক বোতল পানি সংগ্রহের চেষ্টা।
গাজা শহরের বিভিন্ন এলাকা, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চল ও রাফাহ সীমান্ত ঘেঁষা দক্ষিণাঞ্চলে, দিনে দিনে এই বর্বর চিত্র নতুন মাত্রা পেয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপি এবং মানবাধিকার কর্মীদের বরাতে জানা গেছে, সম্প্রতি এমন একাধিক হামলায় নিহত হয়েছেন শত শত বেসামরিক ফিলিস্তিনি—তাদের অধিকাংশই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ।
রোববার (২০ জুলাই, ২০২৫) গাজা সিটির কাছাকাছি একটি পানি বিতরণকেন্দ্রে ত্রাণ নিতে আসা মানুষদের উপর স্নাইপার রাইফেল থেকে গুলি চালায় আইডিএফ (ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী)। একই সময় ট্যাংক থেকেও নির্বিচারে গোলা নিক্ষেপ করা হয়। এ হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন অন্তত ৬৭ জন ফিলিস্তিনি। গাজার নাগরিক সুরক্ষা দপ্তর এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
এদের মধ্যে ছিলেন কাশেম আবু খাতের (৩৬)। তিনি বলেন, “আমি শুধু এক ব্যাগ ময়দা নিতে গিয়েছিলাম। চারদিকে ক্ষুধার্ত মানুষের ভিড়, ধাক্কাধাকি চলছিল। তখনই হঠাৎ গুলি আর বোমা বর্ষণ শুরু হয়। মনে হচ্ছিল, আমরা কোনো প্রাণী, আর ওরা শিকারি। আমার চোখের সামনেই অন্তত ১৫-২০ জন মারা গেল।”
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, মে মাসের শেষ থেকে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে নিহত হয়েছেন অন্তত ৮০০ জন ফিলিস্তিনি। অনেকে গুলিতে মারা যান ত্রাণকেন্দ্রে প্রবেশের আগে, কেউবা মারা যান লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায়, কেউ আবার মারা যান ট্রাক থেকে খাবার নিতে গেলে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (WFP) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, “এ ধরণের হামলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। খাদ্যসঙ্কটে পড়া জনগণের ওপর গুলি চালানো মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।”
২০ জুন গাজা উপত্যকার উত্তরে যখন ২৫টি ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশ করে, তখন হাজারো মানুষ তাতে ভিড় করেন। এরপরই শুরু হয় গুলিবর্ষণ। ৬৭ জন নিহত হন উত্তরাঞ্চলে, রাফাহর কাছের জিএইচএফ পরিচালিত কেন্দ্রে আরও ৬ জন নিহত হন, একদিন আগে একই জায়গায় নিহত হন আরও অনেকে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। বহু আহত ব্যক্তি সংকটাপন্ন অবস্থায় আছেন।
ত্রাণপ্রত্যাশী কাশেম আবু খাতেরের বর্ণনা হৃদয়বিদারক। তিনি বলেন, “আমরা খাবারের জন্য এসেছি, কিন্তু ওরা যেন আমাদের মানুষ ভাবেই না। ওদের স্নাইপাররা ছাদে বসে গুলি করছিল, ট্যাংক থেকে গোলা ছুড়ছিল। এটা ছিল প্রাণী শিকারের দৃশ্য। কেউ কাউকে সাহায্য করতে পারছিল না।”
নাগরিক সুরক্ষা দপ্তরের মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল বলেন, “ইসরায়েলি সেনাদের এমন আচরণ বারবার হচ্ছে। আমরা মৃতদেহ সরাতে গেলে দ্বিতীয় দফায় গুলিবর্ষণ শুরু হয়।”
ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বরাবরের মতোই দাবি করা হয়, তারা ‘সতর্কতামূলক গুলি’ চালিয়েছে। তাদের ভাষায়, “হাজারো মানুষের জমায়েত আমাদের সেনাদের প্রতি তাৎক্ষণিক হুমকি হয়ে উঠেছিল।”
কিন্তু গুলি যাদের উপর চালানো হচ্ছে, তারা সবাই নিরস্ত্র, বেসামরিক ও ক্ষুধার্ত। ফলে এই ‘হুমকির’ ব্যাখ্যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না।
রয়টার্স, এএফপি, আল-জাজিরা, ডয়েচে ভেলে সহ একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এসব হামলার ভয়াবহতা তুলে ধরেছে।
মানবিক সংস্থা যেমন—
ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি (IRC)
ডাক্টরস উইদাউট বর্ডারস (MSF)
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল
তারা সবাই এ ধরনের আচরণকে যুদ্ধাপরাধের শামিল বলে আখ্যা দিয়েছে।
গাজার পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে উঠেছে কারণ সেখানে আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের প্রবেশে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে ইসরায়েল। ফলে তথ্য যাচাই কঠিন হয়ে পড়েছে। এএফপি তাদের প্রতিবেদনেও জানিয়েছে, “আমরা নিরপেক্ষভাবে নিহতের সংখ্যা যাচাই করতে পারিনি।”
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলি ভূখণ্ডে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে ১,২১৯ জন ইসরায়েলি নাগরিককে হত্যা করে। এরপর প্রতিশোধের নামে ইসরায়েল শুরু করে নির্বিচার বিমান ও স্থল হামলা।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৫৮,৮৯৫ জন ফিলিস্তিনি, আহত হয়েছেন আরও প্রায় ১ লাখের বেশি এবং ধ্বংস হয়েছে শহর, হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ, গির্জা—সবই।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী (আইডিএফ) তাদের ওয়েবসাইটে বলেছে, “আমরা ধাপে ধাপে গাজাকে হামাস ও ফিলিস্তিনিদের উপস্থিতি থেকে মুক্ত করবো।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, “এটি প্রকৃতপক্ষে জাতিগত নিধনের ইঙ্গিত দেয়।”
হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে ৬০ দিনের একটি সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে কাতার, মিশর ও যুক্তরাষ্ট্র মধ্যস্থতা করছে। তবে কোনো পক্ষই তাৎক্ষণিক সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েল তাদের সামরিক অভিযান আরও সম্প্রসারণের ঘোষণা দিয়েছে।
গাজার আকাশে আজ আর ড্রোন নয়, নেমে এসেছে এক অন্ধকার—যেখানে জীবনের মূল্য নেই, মানবতার স্পন্দন নেই। ক্ষুধার্ত মানুষের দিকে গুলি চালিয়ে যদি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়, তাহলে বিশ্ব সভ্যতার কাছে এ প্রশ্ন থেকেই যায়—আমরা আদৌ মানুষ, নাকি শুধু অস্ত্রের যোগফল?
বিশ্ব সম্প্রদায়ের এখনই জরুরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন—না হলে গাজা নামের এক ভূখণ্ড হয়তো আর কোনোদিন উঠে দাঁড়াতে পারবে না।
তথ্যসূত্র: এএফপি, রয়টার্স, ইউনাইটেড ন্যাশনস, গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, আল-জাজিরা, মানবাধিকার সংস্থার বার্তা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ