
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ একবছরেরও বেশি সময় ধরে ইসরাইল গাজায় যে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে, তা এখন বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ ও নৃশংস গণহত্যার রূপ নিয়েছে। পশ্চিমা শক্তির সরাসরি সমর্থন ও নীরবতায় পরিচালিত এই মানববিধ্বংসী হামলায় প্রতিদিন গড়ে একশরও বেশি নিরীহ মানুষ নিহত হচ্ছেন, যাদের বেশিরভাগই শিশু ও নারী। অথচ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখনও কার্যত নিশ্চুপ। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার দুঃখ প্রকাশ আর বিবৃতি ছাড়া এই মানবিক বিপর্যয় রোধে কোনও কার্যকর উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়।
জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফ গত ৩১ অক্টোবর গাজাকে অভিহিত করেছিল ‘শিশুদের জন্য এক বিশাল কবরস্থান’ হিসেবে। এই উক্তি তখন শুধু একটি তীব্র প্রতিবাদ ছিল, কিন্তু ২০২৫ সালের জুলাইতে এসে সেটিই গাজা উপত্যকার বাস্তব চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউনিসেফের পরে জাতিসংঘের আরও অনেক সংস্থা ও কর্মকর্তারাও একে একে এই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেছেন।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (UNRWA)-র প্রধান ফিলিপ লাজারিনি সম্প্রতি বলেছেন, “গাজায় ইসরাইল একটি ‘ম্যাকিয়াভেলীয় কৌশলে গণহত্যা’ পরিচালনা করছে।” তার বক্তব্যে স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে যে, এটি কোনো দুর্ঘটনাজনিত সংঘাত নয়—বরং একটি সুপরিকল্পিত ও প্রাতিষ্ঠানিক হত্যাযজ্ঞ, যেখানে শিশুদের কৌশলগতভাবে টার্গেট করা হচ্ছে।
গাজার জনসংখ্যার অর্ধেকই শিশু। এই বিপুল শিশু জনগোষ্ঠী একটি প্রজন্মের প্রতীক—একটি জাতির ভবিষ্যৎ। এবং ইসরাইলের চোখে ভবিষ্যতের এই সম্ভাবনাই সবচেয়ে বড় হুমকি। শিশুদের হত্যা করে শুধু বর্তমান নয়, ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ প্রতিরোধ শক্তিকেও ধ্বংস করতে চায় ইসরাইল।
ইসরাইলি নেতৃবৃন্দ, রাব্বি ও ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো এমন বক্তব্য দিয়েছেন যেখানে প্রতিটি ফিলিস্তিনি শিশুকে সন্ত্রাসী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এমনকি মায়েদেরও হত্যার পক্ষে মত দিয়েছেন, কারণ তারা ‘সন্ত্রাসীর জন্মদাত্রী’। এমন উস্কানিমূলক বক্তব্যের প্রেক্ষিতে শিশুদের উপর বোমাবর্ষণ যেন একটি নীতিগত অভিযানে রূপ নিয়েছে।
২০২৫ সালের ১২ জুলাই, মাত্র ১৭ বছর বয়সে ইউসুফ আল-জাক নামের এক ফিলিস্তিনি কিশোর গাজা শহরের এক বিমান হামলায় নিহত হন। তার সাথে একইসাথে প্রাণ হারায় তার ভাতিজি মারিয়া ও ভাতিজা তামীম। ইউসুফের জীবন কাহিনী হৃদয়বিদারক ও প্রতীকী—সে জন্মেছিল একটি ইসরাইলি কারাগারে।
তার মা ফাতেমা আল-জাক ২০০৭ সালে ইসরাইলি বাহিনীর হাতে আটক হন এবং কারাগারে থাকাকালীন গর্ভবতী হন। ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ তার গর্ভপাত ঘটানোর জন্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায়। শেষপর্যন্ত তিনি পুত্র সন্তান ইউসুফকে জন্ম দেন। কিন্তু জন্মের সময় তার হাত-পা বাঁধা ছিল এবং চিকিৎসাসেবাও ছিল সীমিত। ইউসুফ তার জীবনের প্রথম ২০ মাস কাটান কারাগারে, পরে গিলাদ শালিত বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে মুক্তি পান।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ১৭ হাজারেরও বেশি শিশু নিহত হয়েছে—এটি একটি সংরক্ষিত হিসাব। বাস্তবে ধ্বংসস্তূপে আটকে থাকা হাজারো শিশুর নাম-পরিচয় এখনও অনির্ধারিত। এই হার অনুযায়ী, প্রতিদিন গড়ে ৩০ জন শিশু নিহত হচ্ছে—প্রতি ৪৫ মিনিটে একটি শিশুর প্রাণহানি।
এই হত্যা কোনো ভুল করে ফেলা দুর্ঘটনা নয়। ইসরাইলের অত্যাধুনিক নজরদারি ড্রোন, স্যাটেলাইট, গাইডেড মিসাইল ও বুদ্ধিমত্তাবান সেনা ইউনিট এসব হামলা পরিচালনা করছে। প্রতিটি বোমা বা ক্ষেপণাস্ত্র অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে শিশুবহুল অঞ্চল, স্কুল, হাসপাতাল, আশ্রয়কেন্দ্র, এমনকি শিশুদের খেলার মাঠেও ফেলা হচ্ছে।
গত সপ্তাহে একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয় যেখানে আট মাসের এক গর্ভজাত শিশু—সাঈদ সামের আল-লাক্কা—বোমা বিস্ফোরণে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। ভিডিওটি জনমনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করলেও মূলধারার পশ্চিমা গণমাধ্যমে তা প্রচার হয়নি। বরং এসব গণমাধ্যম শিশুদের মৃত্যু কেবল পরিসংখ্যান হিসেবে তুলে ধরে, তাদের জীবনের গভীর ট্র্যাজেডি কিংবা নৃশংসতার প্রকৃত রূপ প্রচার থেকে বিরত থাকে।
এই নীরবতা ইসরাইলের দীর্ঘমেয়াদি গণহত্যাকে ‘প্রতিরোধহীন এক নির্মূল প্রক্রিয়া’তে পরিণত করেছে।
শিশুদের হত্যা ইসরাইলের একমাত্র কৌশল নয়। এর পেছনে আরও বড় উদ্দেশ্য আছে: ফিলিস্তিনি সমাজের প্রজন্মগত পুনরুৎপাদন ধ্বংস করা। অর্থাৎ এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যাতে একটি জাতির শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্মৃতি ও ঐক্যবদ্ধ পরিচয় ভেঙে যায়।
একদিকে তাৎক্ষণিক মৃত্যু, অন্যদিকে খাদ্য, চিকিৎসা, বিদ্যুৎ, পানির সংকট এবং শিক্ষাব্যবস্থার ধ্বংস—সবকিছু মিলে ফিলিস্তিনিকে ‘বাসযোগ্যতা হারানো এক জনপদে’ পরিণত করতে চায় ইসরাইল। এতে দখল ও বসতি নির্মাণ সহজতর হয়।
এই কৌশল নতুন নয়। ব্রিটিশরা যেমন ১৯৫০-এর দশকে কেনিয়ায় মাউ মাউ বিদ্রোহ দমনে বন্দি শিবিরে আটকে রাখত কিকুয়ু জনগোষ্ঠীকে, ফ্রান্স যেমন আলজেরিয়ায় করেছে, ইসরাইলও গাজায় তেমনি একটি উপনিবেশিক দমননীতির বাস্তবায়ন করছে।
গাজার একটি শিশু কেবল একটি প্রাণ নয়—সে একটি প্রতীক। একটি সম্ভাবনা। তার হাতে থাকা বই, তার চোখের স্বপ্ন ও প্রশ্নই ইসরাইলের জন্য সবচেয়ে বড় ভয়ের নাম। কারণ এই শিশুরাই একদিন হয়ে উঠতে পারে প্রতিরোধের যোদ্ধা—না শুধু অস্ত্রে, বরং চেতনায়, লেখায়, সংগীতে, শিক্ষায়। তাই দখলদারদের চোখে বই হাতে শিশু একজন বোমার চেয়েও ভয়ংকর।
গাজায় শিশুদের হত্যা একটি যুদ্ধকালীন ‘ভুল’ নয়, এটি একটি সুপরিকল্পিত ও কাঠামোগত গণহত্যা—যার উদ্দেশ্য হলো একটি জাতির ভবিষ্যৎ নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। এটি শুধু মৃত্যু নয়, এটি স্মৃতি, পরিচয়, আশা ও স্বপ্নের উপর আঘাত। বিশ্ব যতোদিন এ সত্যকে অস্বীকার করে, ততোদিন গাজার আকাশে শিশুর কান্না ও মৃত্যুর শব্দ গর্জে যাবে অবিরাম।
এবং ইতিহাস একদিন প্রশ্ন করবেই—কে ছিল নির্যাতিত, আর কে ছিল নীরব?
বাংলাবার্তা/এমএইচ