
ছবি: সংগৃহীত
গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) একটি রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সহিংসতা, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ এবং গ্রেপ্তার অভিযানের ঘটনায় পুরো জেলা রীতিমতো আতঙ্কের শহরে পরিণত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে নির্বিচারে গ্রেপ্তারের অভিযোগ তুলেছে সাধারণ মানুষ। মাত্র দু’দিনের ব্যবধানে তিনটি মামলায় ২ হাজার ৬০০ জনকে আসামি করা হয়েছে, আর গ্রেপ্তার করা হয়েছে অন্তত ১৬৭ জনকে।
গোপালগঞ্জে সহিংসতার সূত্রপাত ঘটে বুধবার, যখন এনসিপির সমাবেশস্থল ও নেতাদের গাড়িবহরে হামলা চালায় আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে পাঁচ তরুণ নিহত হন। ঘটনার পর রাত ৮টা থেকে জেলাজুড়ে কারফিউ জারি করা হয়, যা শুক্রবার পর্যন্ত বলবৎ থাকে। শুক্রবার জুমার নামাজের সময় কারফিউ কিছু সময়ের জন্য শিথিল করা হয়।
এই সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনায় সদর, মুকসুদপুর, কাশিয়ানী, টুঙ্গিপাড়া ও কোটালীপাড়া থানায় পৃথক মামলায় হাজার হাজার মানুষকে আসামি করা হয়। গোপালগঞ্জ সদর থানায় দায়ের করা একটি মামলায় ছাত্রলীগের জেলা সভাপতি নিউটন মোল্লা ও সাধারণ সম্পাদক আতাউর পিয়ালসহ ৭৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৪৫০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করা হয়। অভিযোগ, তারা পুলিশের ওপর হামলা ও সরকারি গাড়ি পোড়ানোর সঙ্গে জড়িত। মামলার বাদী সদর উপজেলার গোপীনাথপুর পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক আহম্মেদ আলী।
মুকসুদপুর ও কাশিয়ানী থানায় করা মামলাগুলোতে বিশেষ ক্ষমতা আইন ও সন্ত্রাস দমন আইনে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। কোটালীপাড়ায় করা মামলায় ১ হাজার ৬৫৫ জনকে আসামি করা হয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ১৫৫ জনের নাম রয়েছে। বাকিরা অজ্ঞাতনামা। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সন্দেহভাজনদের যাচাই-বাছাই করে গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে।
যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে অপরাধ সংশ্লিষ্টতা যাচাইয়ের কথা বলা হলেও পরিবারের সদস্যদের দাবি ভিন্ন। গোপালগঞ্জ সদর থানার সামনে আটক হওয়া অনেকের স্বজন ভিড় জমিয়েছেন। ছয়টি পরিবারের সদস্যরা দাবি করেন, তাদের ১৩-১৬ বছর বয়সি শিশু সন্তানদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ এসএসসি পরীক্ষার্থী, কেউ অষ্টম বা নবম শ্রেণির ছাত্র। কেউ রিকশাচালক বাবার একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তান, আবার কেউ মাদ্রাসা শিক্ষার্থী।
একটি ঘটনার কথা বলা যায়: ১৬ বছর বয়সি আবীর হোসেন শুভ তার মায়ের থাইরয়েডের ওষুধ কিনতে গিয়ে পুলিশি অভিযানে গ্রেপ্তার হন। সাথে থাকা তার ফুফাতো ভাই শিপন (১৫)-কেও আটক করা হয়। শুভর মা জানান, তার হাতে তখনো ওষুধ ছিল। অপর এক কিশোর রিপনকে আটক করা হয় বাসার সামনেই ঝালমুড়ি খেতে যাওয়ার সময়। তার মা জানালেন, ছেলের পরীক্ষা চলছিল। এখন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ নিয়েই সংশয় তৈরি হয়েছে।
শুধু শিশুরাই নয়, একাধিক বৃদ্ধ, অসুস্থ ব্যক্তি ও খেটে খাওয়া মানুষও গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছেন। ৭০ বছর বয়সি কৃষক মোদক হালদারকে চা খেতে গিয়ে আটক করা হয়। দেলোয়ার হোসেন নামের ৬০ বছর বয়সি এক মাছ ব্যবসায়ী গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বাসায় ফেরার পরও তাকে আটক করা হয়। ২৩ বছর বয়সি রিকশাচালক ইশা খন্দকারকে শুধু পুলিশের ডাক শুনে দৌড় দেওয়ার জন্য গ্রেপ্তার করা হয় বলে দাবি তার স্ত্রীর।
আরেক কিশোর দীপু বল্লভ লেখাপড়ার পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের কাজ করত। মা জানালেন, তার অসুস্থ বাবার চিকিৎসা চালাতে দীপুই উপার্জনের দায়িত্ব নিয়েছিল। পুলিশ তাকে পানি সরবরাহের সময় আটক করে। এমন নানা বাস্তবতা উঠে এসেছে শতাধিক গ্রেপ্তারের মধ্যে।
গোপালগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও অভিযান) ড. রুহুল আমিন সরকার বলেন, ‘আটক ব্যক্তিদের তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। অপরাধ সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলেই গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে।’ কিন্তু অনেক পরিবার বলছে, থানায় গিয়ে সন্তানদের খোঁজ পেলেও কোনো ধরনের অভিযোগ জানানো হচ্ছে না, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত জানানোও হবে না বলা হয়েছে।
মানবাধিকারকর্মীরা বিষয়টিকে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে দেখছেন। স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের মতে, এ ধরনের গণগ্রেপ্তার ও মামলার ফলে অনেক নিরপরাধ মানুষ দীর্ঘদিন ভোগান্তির শিকার হবেন। অপরাধী চিহ্নিত করা জরুরি হলেও, অন্ধগ্রেপ্তার ও ভীতি ছড়ানোর পরিবেশ একটি নাগরিক সমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ।
গোপালগঞ্জে এনসিপির কর্মসূচিকে ঘিরে সহিংসতার জেরে উদ্ভূত পরিস্থিতি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণযোগ্য হলেও এতে যে সাধারণ জনগণ, শিশু-কিশোর, খেটে খাওয়া মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন—তা অস্বীকার করা যায় না। প্রশাসনের উচিত হবে স্বচ্ছ ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তদন্ত পরিচালনা করা এবং নিরপরাধদের মুক্তি নিশ্চিত করা। অন্যথায় এই ঘটনাগুলোই জনমনে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নতুন করে অনাস্থা তৈরি করতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ