
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা পণ্যের ওপর বর্তমান গড় শুল্ক প্রায় ৬ শতাংশ হলেও, সেটি কমিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই উদ্যোগ আসন্ন তৃতীয় দফার বাণিজ্য আলোচনার প্রেক্ষাপটে নেওয়া হচ্ছে, যেখানে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তারা মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন।
গত ৮ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেন, যা ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যে ইতোমধ্যে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপিত ছিল, ফলে নতুন শুল্কের পর মোট শুল্ক ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে আমদানি পণ্যে শুল্ক ছাড় দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, যা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম, এলএনজি (প্রাকৃতিক গ্যাস), উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ ও ভোজ্য তেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এছাড়া বেসরকারিভাবে তুলা আমদানির সুযোগও সৃষ্টি করা হচ্ছে। এসব পদক্ষেপ মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আসন্ন আলোচনার ফলস্বরূপ বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নত করতে নেয়া হচ্ছে।
আগামী সপ্তাহের শেষের দিকে তৃতীয় দফার বাণিজ্য আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যদিও এখনো নির্দিষ্ট তারিখ চূড়ান্ত হয়নি। আলোচনায় নেতৃত্ব দেবেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন। এছাড়া দেশের ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে, যারা মার্কিন ব্র্যান্ড ও আমদানিকারকদের সঙ্গে বৈঠক করে সহযোগিতার হাত বাড়াবেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (এনডিএ) থাকায় সরকারি দলের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের একযোগে আলোচনায় অংশগ্রহণ সীমিত হলেও বিকল্প পদ্ধতিতে তারা পরামর্শ দিচ্ছেন। আলোচনায় মার্কিন বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ইউএস হুইট অ্যাসোসিয়েটস, শেভরন, এক্সিলারেট এনার্জি এবং ২২ জুলাই আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের (এএএফএ) সঙ্গে বৈঠকের পরিকল্পনা রয়েছে।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ী নেতারা সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক কমানোর জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। বাংলাদেশের নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “আমাদের শুল্ক ভারত ও ভিয়েতনামের কাছাকাছি হলে আমরা আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে পারব। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক সংক্রান্ত আলোচনায় সরকারের প্রস্তুতি ইতোমধ্যে সন্তোষজনক। তবে ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্র যাওয়া নিয়ে এখনো সরকারি পক্ষ থেকে বিস্তারিত জানা যায়নি।”
অর্থনীতিবিদ ও বাণিজ্য বিশ্লেষক ড. রোজিনা ইসলাম বলেন, “পাল্টা শুল্কের চাপ সামলাতে আমদানি শুল্ক ছাড় একটি যৌক্তিক পদক্ষেপ। এতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ভারসাম্য বজায় রাখা সহজ হবে। তবে এর পাশাপাশি আমাদের উচিত বাণিজ্য বৈচিত্র্যকরণ এবং স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানো।”
অন্যদিকে বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ এবং সাবেক কূটনীতিক এম. এ. জামান বলেন, “বাণিজ্য আলোচনায় সফলতা আসার জন্য আমাদের সরকারি দল এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে সমন্বয় জরুরি। আমদানিতে শুল্ক কমানো হলে সরবরাহ চেইনে সুবিধা আসবে এবং এতে রপ্তানিতে প্রভাব পড়বে। তবে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই উন্নয়নের জন্য শিল্পায়ন ও মানোন্নয়ন কর্মসূচি চালু রাখতে হবে।”
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত পণ্যের শুল্ক ছাড় দিয়ে তারা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য কার্যকর কৌশল গ্রহণের পথে। এছাড়া বাণিজ্য আলোচনার আগে দেশি ব্যবসায়ীদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ও আমদানিকারকদের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতার লক্ষ্যে বিভিন্ন বৈঠক হচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেওয়া হলে আমদানি ব্যয় কমবে, যা দেশের ভোক্তা ও শিল্পোদ্যোগীদের জন্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এটি আমাদের বাণিজ্য ব্যবস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।”
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তৃতীয় দফার বাণিজ্য আলোচনা সামনে রেখে বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমদানি শুল্ক ছাড়ের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছে। এতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও জোরদার হবে এবং বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান সুদৃঢ় করতে পারবে। বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ী উভয়ই এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, সঠিক সমন্বয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ বাণিজ্যে আরও লাভজনক পরিস্থিতি তৈরি করতে সক্ষম হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ