
ছবি: সংগৃহীত
জীবনের গতি যতই বেড়ে চলুক, স্বাস্থ্যই সবার আগে—এই উপলব্ধিতে এখন অনেকেই প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসে ভেষজ উপাদান যুক্ত করছেন। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার আগে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন কোনো প্রাকৃতিক সমাধান খুঁজতে চান অনেকেই। এমন একটি সহজলভ্য অথচ বিস্ময়কর স্বাস্থ্যকর উপাদান হচ্ছে রান্নাঘরের পরিচিত মসলা মৌরি। বহু প্রাচীনকাল থেকেই এটি শুধু রান্নার উপকরণ নয়, বরং ঘরোয়া চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিশেষ করে সকালে খালি পেটে মৌরি ভেজানো পানি পান করলে মিলতে পারে নানাবিধ উপকারিতা—যা দেহ ও মনের সার্বিক সুস্থতায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
আমেরিকান হেলথ লাইন, টাইমস অব ইন্ডিয়াসহ একাধিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক গবেষণায় মৌরির গুণাগুণের বিষয়ে বিস্তর তথ্য উঠে এসেছে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, মৌরি হলো প্রাকৃতিক অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদানসমৃদ্ধ এক অনন্য ভেষজ উপাদান।
প্রতিদিন সকালে এক গ্লাস পানি রাতভর ভিজিয়ে রাখা মৌরি পান করলে শরীর ও মনের যে উপকার হয়, তা দীর্ঘমেয়াদে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
সাধারণত যাদের বদহজম বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা রয়েছে, তারা নিয়মিত মৌরি ভেজানো পানি খেলে উপকার পেতে পারেন। মৌরিতে থাকা প্রাকৃতিক তেল হজমশক্তি বাড়ায় এবং গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিডের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখে। মৌরি অন্ত্রে অস্বস্তি কমায় ও পেট ফাঁপার প্রবণতা হ্রাস করে। তাই যাদের প্রতিদিন সকালে পেট পরিষ্কার হয় না, তাদের জন্য এটি অত্যন্ত কার্যকর একটি প্রাকৃতিক সমাধান হতে পারে।
মৌরিতে রয়েছে পর্যাপ্ত ফাইবার, যা কেবল হজমেই সাহায্য করে না, বরং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধেও ভূমিকা রাখে। নিয়মিত মৌরি পানি পান করলে অন্ত্রে মল চলাচল সহজ হয়, ফলে পরিপাকতন্ত্র সচল থাকে এবং পেটের গ্যাস-ফাঁপা থেকেও মুক্তি পাওয়া সম্ভব হয়।
বর্তমানে হৃদরোগ একটি বহুল প্রচলিত সমস্যা। উচ্চ কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড ও রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া হৃদরোগের প্রধান কারণগুলোর একটি। মৌরিতে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদানগুলো রক্তনালির প্রদাহ হ্রাস করে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়। ফলে যারা হৃদযন্ত্রের সুস্থতায় প্রাকৃতিক কোনো পথ খুঁজছেন, তাদের জন্য এটি হতে পারে উপযুক্ত পছন্দ।
মৌরি ভেজানো পানি মেটাবলিজম বাড়াতে সাহায্য করে, ফলে শরীর দ্রুত ক্যালোরি পোড়াতে পারে। এতে করে ওজন কমাতে এটি কার্যকরী হতে পারে। যারা ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান, তাদের প্রতিদিন সকালে এক গ্লাস মৌরি ভেজানো পানি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত।
নারীদের নানা সময় বিভিন্ন হরমোনজনিত সমস্যায় পড়তে হয়—যেমন পিরিয়ডের ব্যথা, মেনোপজকালীন অস্বস্তি, ঘুমের সমস্যা কিংবা যৌনাঙ্গে চুলকানি-শুষ্কতা। মৌরি এমন কিছু ভেষজ উপাদান সরবরাহ করে, যা শরীরের হরমোন ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক। এতে রয়েছে ফাইটো-ইস্ট্রোজেন নামক উপাদান, যা প্রাকৃতিকভাবে ইস্ট্রোজেন হরমোনের ঘাটতি পূরণে সহায়ক।
মৌরির রয়েছে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি গুণাবলি। এটি শুধু গ্যাস্ট্রিক নয়, শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে গোপনে চলতে থাকা দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। পাশাপাশি মৌরির মৃদু ঘ্রাণ ও উপাদানগুলো মস্তিষ্ককে প্রশান্ত করে এবং দুশ্চিন্তা কমায়, ঘুমের গুণগতমানও বাড়ায়।
মৌরি বীজে রয়েছে প্রাকৃতিক ডায়িউরেটিক বা মূত্রবর্ধক বৈশিষ্ট্য, যা শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি এবং ক্ষতিকর টক্সিন বের করে দেয়। এর মাধ্যমে কিডনি পরিষ্কার থাকে এবং ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের ঝুঁকিও কমে।
মৌরির অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল গুণ শরীরে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার রোধ করে এবং সেলুলার লেভেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এতে করে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাল সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকটাই হ্রাস পায়।
এক চামচ মৌরি রাতে এক গ্লাস পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে খালি পেটে সেই পানি পান করুন। চাইলে মৌরি চিবিয়েও খাওয়া যেতে পারে। আবার ঘুমানোর আগেও একবার এই অভ্যাস করলে ঘুম ভালো হয় ও হজমপ্রক্রিয়ায় সহায়তা মেলে।
মৌরি একটি সহজলভ্য অথচ দারুণ কার্যকর ভেষজ উপাদান। এর ব্যবহার যেমন সহজ, তেমনই উপকারিতাও বিস্ময়কর। নিয়মিত সকালে মৌরি ভেজানো পানি পান করলে হজম, হৃদরোগ, ওজন নিয়ন্ত্রণ, নারীদের স্বাস্থ্য, মানসিক প্রশান্তি, কিডনি কার্যকারিতা—সবকিছুরই উন্নতি সম্ভব। তাই দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসে ও স্বাস্থ্যরুটিনে মৌরির মতো প্রাকৃতিক উপাদানকে গুরুত্ব দিন, ওষুধের চেয়ে আগেভাগেই সুস্থ থাকার পথ খুঁজুন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ