
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সম্প্রতি পোশাকশিল্পে ব্যবহৃত তুলা ও কৃত্রিম আঁশ আমদানিতে আরোপিত ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে। এই কর প্রত্যাহার টেক্সটাইল শিল্পখাতের পক্ষ থেকে জোরালো আপত্তির পর নেওয়া হলো। বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) এনবিআরের করনীতি বিভাগের সদস্য এ কে এম বদিউল আলম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপন জারি করে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। তবে কর ছাড়ের সুবিধা শুধুমাত্র শিল্পখাতের আমদানি নিবন্ধন সনদ (আইআরসি)ধারীদের জন্য প্রযোজ্য থাকবে, বাণিজ্যিক আমদানিকারকরা এই সুবিধা পাবেন না।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে তুলা ও কৃত্রিম আঁশসহ ১৫০টির বেশি কাঁচামালের ওপর ২ শতাংশ অগ্রিম কর আরোপ করা হয়। এনবিআরের প্রত্যাশা ছিল এই কর আরোপের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ করা যাবে। কিন্তু টেক্সটাইল শিল্পের মালিকরা তাৎক্ষণিকভাবে বিরোধ প্রকাশ করেন। তারা জানান, এ কর আরোপের ফলে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে অনেক স্পিনিং মিল বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে, যা দেশের গার্মেন্টস রপ্তানি খাতের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
বাংলাদেশ প্রতিবছর গার্মেন্ট রপ্তানি ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে আমদানিকৃত তুলার প্রায় ৯৯ শতাংশ ব্যবহার করে থাকে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) জানায়, ২০২৪ সালে দেশে আমদানি হয়েছে ৮৩ লাখ ২১ হাজার বেল তুলা, যার মধ্যে ৪৩ শতাংশ এসেছে আফ্রিকা থেকে। এছাড়া ভারত, সিআইএস দেশ, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র থেকেও তুলা আমদানি করা হয়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির অংশ ৭ শতাংশের বেশি।
এনবিআরের প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, আয়কর আইন ২০২৩-এর ধারা ৩৪৩ এবং উৎসে কর বিধিমালা ২০২৪-এর বিধি ৮-এর অধীনে আমদানিকৃত তুলা ও সিনথেটিক স্ট্যাপল ফাইবার, অ্যাক্রেলিক, আর্টিফিশিয়াল স্ট্যাপল ফাইবারের ওপর উৎসে করের হার শূন্য শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ফলে চলতি বছরে তুলা আমদানিতে আরোপিত ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহার করা হয়েছে।
বিটিএমএর আওতায় রয়েছে প্রায় ১৮৫৮টি সুতাকল, উইভিং, ডাইং-প্রিন্টিং-ফিনিশিং বস্ত্রকল, যার মোট বিনিয়োগ প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার। এই বস্ত্র খাত তৈরি পোশাকশিল্পে ব্যবহৃত সুতা ও কাপড়ের প্রায় ৭০ শতাংশ সরবরাহ করে। উৎসে কর প্রত্যাহারের মাধ্যমে স্পিনিং ও টেক্সটাইল মিলগুলোর কার্যকর মূলধনের ওপর চাপ কমবে এবং তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী।
বিটিএমএর সহ-সভাপতি ও এনজেড টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালেউদ জামান খান বলেন, “সরকারি করের হার ২৭ শতাংশ হলেও, ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর থাকলে আমাদের কারখানার কার্যকর করহার দাঁড়াত ৬৪ শতাংশের মতো, যা টেক্সটাইল শিল্পের জন্য বহনযোগ্য নয়। বছরে তুলা আমদানিতে প্রায় ৩২ কোটি টাকা কর দিতে হতো, যা কোনো কারখানাই আয় করতে পারে না। তাই কর প্রত্যাহার অত্যন্ত জরুরি ছিল।”
বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের তুলা ও কৃত্রিম আঁশ আমদানি করে। এই কর প্রত্যাহার শুধু তুলা নয়, একই সঙ্গে সিনথেটিক আঁশ যেমন অ্যাক্রিলিক, নাইলন, পলিয়েস্টার ইত্যাদি কাঁচামালের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, যেগুলোর বেশিরভাগই আসে চীন থেকে।
বিটিএমএ দীর্ঘদিন ধরে ফাইবার আমদানিতে অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছে। তারা বলেন, রপ্তানি সরবরাহ শৃঙ্খলের প্রতিষ্ঠানগুলো কর অব্যাহতির আওতায় থাকায় ইনপুট ট্যাক্স ও প্রকৃত আয়ের মধ্যে বৈষম্য তৈরি হয়, যা খাতটির জন্য একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়। কর প্রত্যাহারের ফলে ব্যবসায়িক ব্যয় কমে যাবে এবং টেক্সটাইল শিল্পের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এ উদ্যোগ দেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি খাত পোশাকশিল্পের জন্য একটি বড় সহায়তা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কর প্রত্যাহারের মাধ্যমে টেক্সটাইল খাতের মূলধন ও উৎপাদন খরচে উল্লেখযোগ্য হ্রাস আসবে, যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের প্রতিযোগিতা বাড়াবে। এই সিদ্ধান্ত শিল্প ও সরকারের মধ্যে সমঝোতার ফলাফল ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিকনির্দেশনা হিসেবে পরিগণিত হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ