
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক কার্যক্রমে নানা বাধা ও নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়ে চলা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আজ শনিবার (১৯ জুলাই) ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত করছে তাদের বহু প্রত্যাশিত জাতীয় সমাবেশ। বিগত দুই দশকের বেশি সময় পর এই প্রথমবারের মতো দলটি উন্মুক্তভাবে এমন বৃহৎ রাজনৈতিক জমায়েত আয়োজন করতে যাচ্ছে। জামায়াতের দাবি, এই সমাবেশে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করবে, যা তাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি মাইলফলক হতে যাচ্ছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সমাবেশ সফল করতে কেন্দ্রীয়ভাবে গঠিত হয়েছে একটি বাস্তবায়ন কমিটি এবং অধীন আটটি উপকমিটি, যারা গত কয়েক মাস ধরে তৃণমূল থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে কাজ করেছে। সমাবেশের আগে সারা দেশে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়েছে—ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার ছাড়াও ভ্রাম্যমাণ মাইক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও বার্তা, নাটিকা, স্লোগান ও দেশাত্মবোধক গানের মাধ্যমে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।
সমাবেশস্থলে ঢোকার ২০টি নির্ধারিত পয়েন্টে মোতায়েন থাকবে প্রায় ছয় হাজার প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক, যাঁদের জন্য থাকবে নির্ধারিত ইউনিফর্ম। আয়োজকদের ভাষ্যমতে, এদের প্রত্যেকেই দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকার নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা ও গতি-ব্যবস্থাপনার তদারকি করবেন। ঢাকার বাইরে থেকে আগত বাস, লঞ্চ, ট্রেনযোগে অংশগ্রহণকারীদের গাড়ি রাখার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫টি আলাদা পার্কিং জোন।
সমাবেশস্থলে বিশাল জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে স্থাপন করা হয়েছে ১৫টি মেডিক্যাল বুথ, প্রতিটি বুথে থাকবেন অন্তত দুজন করে এমবিবিএস চিকিৎসক এবং প্রয়োজনীয় ওষুধসহ অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস। আর পুরো সমাবেশের দৃশ্য ড্রোন ও উচ্চক্ষমতার ক্যামেরায় ধারণ করে তা সরাসরি প্রচার করা হবে এলইডি স্ক্রিন, ফেসবুক এবং ইউটিউবে।
সমাবেশ শুরু হবে দুপুর ২টায়। তবে সকাল ১০টা থেকেই থাকবে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। মূল অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান। এতে উপস্থিত থাকবেন কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন জেলার আমির ও শুরা সদস্যগণ।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের জানিয়েছেন, সমাবেশে বিএনপিসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে ২০০১ সালের জুলাই আন্দোলনে নিহত ও আহতদের পরিবারকেও ‘সম্মানিত অতিথি’ হিসেবে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
সমাবেশের মূল উপজীব্য ৭ দফা দাবি, যা দলটি আজকের অনুষ্ঠানে জনসমক্ষে উপস্থাপন করবে। এই দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে— অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তায় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রতিষ্ঠা, সব গণহত্যার বিচার, প্রয়োজনীয় মৌলিক রাজনৈতিক সংস্কার, জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন, আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের পুনর্বাসন, প্রতিনিধিত্বমূলক (PR) পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন এবং প্রবাসী ভোটারদের (এক কোটির বেশি) ভোটাধিকার নিশ্চিত করা।
দলটি বলছে, এই সাত দফা বাস্তবায়নই হবে ভবিষ্যৎ রাজনীতির ভিত্তি। সমাবেশের মধ্য দিয়ে জনমত তৈরি করে দাবিগুলো কার্যকর করতে তারা রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক আন্দোলনকে নতুন গতি দিতে চায়।
দলটির নেতারা জানিয়েছেন, সারা দেশ থেকে ঢাকা অভিমুখে আসা লোকজনের জন্য প্রায় ১০ হাজার বাস, ট্রেন ও লঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ ও ময়মনসিংহ রুটে তিনটি বিশেষ ট্রেন পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে।
সমাবেশে আগতদের সুবিধার্থে জামায়াত ঢাকা মহানগর ও আশপাশের এলাকাগুলোর জন্য স্বতন্ত্র ট্রাফিক গাইডলাইনও প্রস্তুত করেছে, যাতে করে পার্কিং ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা যায়।
সমাবেশ উপলক্ষে মহানগরে সম্ভাব্য যানজট ও জনদুর্ভোগ সম্পর্কে আগাম সতর্কতা দিয়ে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘ঢাকাবাসীর কাছে আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। এই ভোগান্তি দেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমাদের আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিবেচনা করতে আহ্বান জানাই।’
অনেকের মতে, জামায়াতে ইসলামীর এই সমাবেশ কেবল একটি রাজনৈতিক সভা নয়, বরং এটি দলটির পুনরায় রাজনৈতিক মাঠে সক্রিয় উপস্থিতির এক বৃহৎ ঘোষণা। বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন, এই সমাবেশের মধ্য দিয়ে দলটি তাদের সাংগঠনিক শক্তি, গ্রহণযোগ্যতা এবং আন্দোলনের বার্তা জনগণের কাছে পৌঁছাতে চাইছে।
সরকারের তরফ থেকে এখন পর্যন্ত বড় কোনো বাধা না আসায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, হয়তো কোনো শর্তসাপেক্ষে জামায়াতকে সীমিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের একটি সুযোগ দেওয়া হচ্ছে—যা জাতীয় নির্বাচনের প্রাকপ্রস্তুতির অংশ হিসেবেও দেখা যেতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ