
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের বিচার বিভাগে নজিরবিহীন একটি অধ্যায়ের সূচনা হলো। দেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা—অর্থাৎ ভাইভা নেওয়া হলো। শুক্রবার (১৯ জুলাই) সকাল ১০টা থেকে বিকেল পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট ভবনের নির্ধারিত কক্ষে এই মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
এই পরীক্ষায় অংশ নেন ৫৩ জন অভিজ্ঞ আইনজীবী, যাঁরা হাইকোর্টের বিচারপতি পদে নিয়োগের জন্য চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁদের সবাইকে একে একে ভাইভা বোর্ডে হাজির হয়ে নিজের যোগ্যতা, বিচারবোধ, পেশাগত অভিজ্ঞতা ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে হয়।
এবারের এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে নবগঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। তাঁর সঙ্গে ছিলেন কাউন্সিলের চারজন স্থায়ী সদস্য—আপিল বিভাগের প্রবীণতম বিচারপতি, হাইকোর্ট বিভাগের প্রবীণতম বিচারপতি (বিচার বিভাগ থেকে নয়), বিচার বিভাগ থেকে আসা হাইকোর্ট বিভাগের প্রবীণতম বিচারপতি এবং অ্যাটর্নি জেনারেল।
বহুদিন ধরে দেশের বিচার বিভাগে বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে নানা মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে। বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও পেশাগত মেধার চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্য ও সুপারিশের ভূমিকাই মুখ্য হয়ে উঠেছিল—এমন অভিযোগ ছিল নানা মহলের।
তবে এবারই প্রথম সেই প্রচলিত ধারা ভেঙে বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়ায় যোগ হয়েছে আনুষ্ঠানিক ভাইভা বোর্ডের মুখোমুখি পরীক্ষা। নিয়োগপ্রক্রিয়ার শুরুতে একটি গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে আবেদন আহ্বান করে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
গত ২৮ মে প্রকাশিত সেই বিজ্ঞপ্তিতে তিন শতাধিক আইনজীবী আবেদন করেন। আবেদনকারীদের মধ্য থেকে একাধিক ধাপে যোগ্যতা যাচাই ও প্রাথমিক বাছাইয়ের মাধ্যমে ৫৩ জনের একটি চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করা হয়।
এই তালিকাভুক্ত প্রার্থীদের শুক্রবার ভাইভায় ডাকা হয়। প্রত্যেককে পেশাগত জীবন, সংবিধান ও আইন সম্পর্কে জ্ঞানের গভীরতা, বিচারিক ভারসাম্য, নৈতিক অবস্থান এবং মানবাধিকার সম্পর্কে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে মূল্যায়ন করা হয়।
এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি পরিচালিত হয়েছে সদ্য প্রণীত ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ-২০২৫’ অনুসারে। অধ্যাদেশ অনুযায়ী, বিচারপতি নিয়োগে সুপারিশের ভিত্তিতে নয়, বরং খোলামেলা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যোগ্যদের নির্বাচন করতে হবে।
এই অধ্যাদেশের আওতায় গঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল এবারই প্রথম বিচারপতি নিয়োগের আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন করছে। নতুন আইন অনুযায়ী, কাউন্সিলের দায়িত্ব শুধু তালিকা তৈরি করাই নয়, প্রার্থীদের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করে রাষ্ট্রপতির কাছে বিচারপতি নিয়োগের জন্য সুপারিশ পাঠানো।
এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছে দেশের বিশিষ্ট আইনজীবীরা। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, এর ফলে বিচার বিভাগে মেধা, দক্ষতা ও নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে বিচারপতি নিয়োগের নতুন এক যুগ শুরু হলো।
তাঁদের মতে, রাজনৈতিক প্রভাব বা বিশেষ গোষ্ঠীর অনুগ্রহের বদলে স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারপতি নিয়োগ হলে জনগণের আস্থা বাড়বে বিচার বিভাগের প্রতি। একই সঙ্গে এটি বিচারকদের স্বাধীনতা ও দায়িত্বশীলতাকেও আরও জোরদার করবে।
ভাইভার পরবর্তী ধাপে এখন এই ৫৩ জনের মধ্য থেকে চূড়ান্তভাবে কতজনকে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হবে—তা নির্ধারণ করবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল। এরপর তাদের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে।
রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দিলে এই নিয়োগ আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হবে এবং নতুন বিচারপতিরা শপথ গ্রহণের মাধ্যমে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন হাইকোর্ট বিভাগে।
বাংলাদেশের বিচার বিভাগে এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত—যেখানে মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে বিচারপতি নিয়োগের পদক্ষেপ এক যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত হয়ে থাকছে। এতে বিচারিক মান ও জনআস্থার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হওয়ার প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ