
ছবি: সংগৃহীত
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের লাগাতার হামলা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাত্রা প্রতিদিনই নতুন মাত্রায় পৌঁছাচ্ছে। গতকাল শনিবার (১৯ জুলাই) দিনভর ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন আরও ১১৬ জন ফিলিস্তিনি। নিহতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী, শিশু ও বয়স্ক নাগরিক রয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৩৮ জন শুধুমাত্র খাদ্য সহায়তা নিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে আবারও প্রশ্ন উঠেছে ইসরাইলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহলের নিষ্ক্রিয়তা এবং পশ্চিমা শক্তিগুলোর নীরব সমর্থন নিয়ে।
আল জাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, শনিবার সকালে গাজার খান ইউনিস ও রাফাহ শহরে অবস্থিত দুটি সহায়তা বিতরণ কেন্দ্রের সামনে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ক্ষুধার্ত মানুষজন। যুদ্ধ, অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞার কারণে দিনের পর দিন খাবার না পেয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন তারা। এই সহায়তা পাওয়ার আশাতেই হাজার হাজার মানুষ সকাল থেকে লাইনে দাঁড়ান।
কিন্তু লাইনের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে এবং পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই আশপাশে অবস্থান নেয় ইসরাইলি সেনারা। কিছু সময় পর গুলিবর্ষণ শুরু হলে মুহূর্তেই রক্তাক্ত হয় সহায়তা কেন্দ্রগুলোর চারপাশ। হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, শুধু এ ঘটনায় গুলিতে মারা গেছেন ৩৮ জন এবং আহত হয়েছেন আরও অনেক। আহতদের অনেকেই সংকটাপন্ন অবস্থায় চিকিৎসাধীন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এটি ছিল পূর্ব পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তাদের ভাষায়, ‘এই গুলি ছিল সরাসরি হত্যার উদ্দেশ্যে ছোড়া, যেন নিরস্ত্র ও ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিরাই ছিল লক্ষ্যবস্তু।’ মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস মনিটর জানিয়েছে, শুধুমাত্র গত ছয় সপ্তাহে গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)-এর চারটি সহায়তা বিতরণ কেন্দ্রের আশেপাশে ইসরাইলি হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৬৭৪ জন।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, মার্চ মাসে ইসরাইল কর্তৃক গাজায় খাদ্য সরবরাহে কঠোর বিধিনিষেধ জারি করার পর থেকে উপত্যকাটিতে অপুষ্টির শিকার শিশুদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত অন্তত ৬৯ জন শিশু অপুষ্টি ও অনাহারে মারা গেছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, প্রতিদিন অসংখ্য শিশু ও নারী অপুষ্টি ও দুর্বলতার কারণে হাসপাতালে আসছে। তাদের শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান নেই, অনেকেই এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে তারা হাঁটতে বা কথা বলতে পারছে না। কারও কারও স্মৃতিশক্তিও লোপ পাচ্ছে। গাজার আল শিফা হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, সাম্প্রতিক দিনগুলোতে শত শত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই চিকিৎসা ছাড়া মারা যেতে পারে।
দুঃখজনক বিষয় হলো, এসব রোগীর চিকিৎসা করতে হাসপাতালগুলোয় নেই পর্যাপ্ত ওষুধ, নেই চিকিৎসা সামগ্রী বা পথ্য। চিকিৎসকরা জানান, আন্তর্জাতিক সাহায্য অনুপস্থিত এবং ইসরাইলি অবরোধের কারণে কোনোভাবেই পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এই পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের সামরিক শাখার মুখপাত্র আবু ওবাইদা একটি ভিডিও বার্তায় হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, গাজায় গণহত্যা অব্যাহত রাখলে ইসরাইলকে আরও বড় ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে। তিনি বলেন, “আমরা ক্ষয়ক্ষতির যুদ্ধ চালিয়ে যেতে প্রস্তুত। ইসরাইলি সেনাদের হত্যা কিংবা বন্দি করার লক্ষ্যে গাজাজুড়ে আমাদের অভিযান চলবে।” তিনি আরও জানান, ইসরাইলি বাহিনী যতই মানবিক সহায়তার আড়ালে হত্যা চালাক, হামাস এর উপযুক্ত জবাব দেবে।
গাজার চলমান মানবিক বিপর্যয় এবং প্রতিনিয়ত বেসামরিক নাগরিকদের হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে এখনো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি জাতিসংঘ বা বিশ্বশক্তিগুলো। পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো একদিকে মানবিক সহায়তা পাঠানোর ঘোষণা দিলেও, অন্যদিকে ইসরাইলের সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নীরবতা পালন করছে। এই দ্বিমুখী নীতির ফলে ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ যেন কোনোভাবেই কমছে না।
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আরব লিগসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে—অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং মানবিক করিডোর খোলার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে, যাতে অন্তত খাদ্য, ওষুধ ও চিকিৎসাসেবা পৌঁছানো সম্ভব হয়।
গাজায় প্রতিদিন যে পরিমাণ রক্ত ঝরছে, তাতে করে মানবতার শেষ রক্ষাটুকুও যেন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে। বিশ্ব কী আরও কত মৃত্যু দেখলে জাগবে, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ