
ছবি: সংগৃহীত
চলমান উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষায় উত্তরপত্র মূল্যায়নে চাঞ্চল্যকর অনিয়মের অভিযোগে ৮ জন পরীক্ষকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একাধিক ছবি ও ভিডিওতে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের দিয়ে পরীক্ষার খাতায় বৃত্ত পূরণ করানো হচ্ছে—যা নির্ধারিত মূল্যায়ন নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। প্রাথমিক তদন্তে এসব অভিযোগের সত্যতা মেলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
রোববার (২০ জুলাই) বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দারের স্বাক্ষরিত পৃথক চিঠির মাধ্যমে অভিযুক্ত পরীক্ষকদের কাছে ‘কারণ দর্শানো নোটিশ’ পাঠানো হয়। চিঠিতে বলা হয়, পরীক্ষকের দায়িত্বে থেকে খাতার গোপন অংশ মূল্যায়নের কাজ অন্য কাউকে দিয়ে করানো একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এতে শিক্ষাব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যেও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যেসব পরীক্ষকের বিরুদ্ধে এই অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে, তারা হলেন—
মধুছন্দা লিপি, নরসিংদীর বারৈচা কলেজ (বাংলা ১ম পত্র)
মো. জাকির হোসাইন, হাজী ইউনুছ আলী কলেজ, সাভার (বাংলা ২য় পত্র)
মো. রাকিবুল হাসান, ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার আনসার ভিডিপি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, গাজীপুর (বাংলা ২য় পত্র)
মুরছানা আক্তার, রোকেয়া আহসান কলেজ, ডেমরা (ইংরেজি ২য় পত্র)
আবু বকর সিদ্দিক, মুন্সীনগর উচ্চ বিদ্যালয়, নবাবগঞ্জ (গণিত)
সমীরময় মন্ডল, রাজবাড়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (গণিত)
মো. সাখাওয়াত হোসাইন আকন, যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ (ইসলাম শিক্ষা)
মহসীন আলামীন, সেন্ট যোসেফস হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ (উচ্চতর গণিত)
বোর্ডের পাঠানো চিঠিতে এ সকল শিক্ষকদের আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি বোর্ড তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রধান, সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে অবহিত করেছে।
মূলত পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন অত্যন্ত গোপনীয় ও সংবেদনশীল একটি প্রক্রিয়া। সেখানে নিরপেক্ষতা, সততা এবং নিয়মবিধির কঠোর অনুসরণ অত্যাবশ্যক। অথচ সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিও ও ছবিতে দেখা যায়, কিছু পরীক্ষক খাতা মূল্যায়নের ‘গোপন অংশ’ অর্থাৎ এমসিকিউ অংশের বৃত্ত পূরণের দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছেন শিক্ষার্থী বা তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে। যা স্পষ্টতই দায়িত্ব পালনে অবহেলা এবং নৈতিক বিচ্যুতি।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ড এই বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখছে। প্রতিষ্ঠানটির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, খাতা মূল্যায়নের এই অনিয়ম শুধু শিক্ষা বোর্ডের ভাবমূর্তিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, বরং পুরো পাবলিক পরীক্ষার গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
বোর্ডের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “এটা কেবল দায়িত্বজ্ঞানহীনতা নয়, বরং জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ন্যায্য মূল্যায়ন প্রক্রিয়াকে কলুষিত করার শামিল। এ ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।”
এদিকে শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি কেন্দ্রীয় তদন্ত কমিটি গঠনের চিন্তাভাবনা চলছে। এই কমিটি অভিযুক্ত পরীক্ষকদের বিরুদ্ধে আরও গভীর তদন্ত করে বোর্ডের কাছে সুপারিশ জমা দেবে। এরপর বোর্ড প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেবে, যার মধ্যে চাকরি স্থগিত, স্থায়ীভাবে মূল্যায়ন কার্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া অথবা অন্যান্য শাস্তি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা আশঙ্কা করছেন, এ ধরনের অনিয়ম শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সমাজের আস্থাকে চরমভাবে ধ্বংস করতে পারে। তাই শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে দ্রুত ও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
এই ঘটনা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিগোচর হয়েছে বলেও নিশ্চিত করেছে বোর্ড। চিঠির অনুলিপি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে এবং বোর্ডকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। বোর্ড জানিয়েছে, অনিয়ম প্রমাণিত হলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তি দেওয়া হবে এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা যেন পুনরায় না ঘটে—সেই লক্ষ্যে মূল্যায়ন ব্যবস্থায় নজরদারি বাড়ানো হবে।
এটাই প্রথম নয়, এর আগেও বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় খাতা মূল্যায়নে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রমাণসহ এই ঘটনায় তা আরও বেশি আলোচিত হয়ে ওঠে। কিছুদিন আগেই ওএমআর শিট শিক্ষকের অফিসে বসে শিক্ষার্থীদের দিয়ে পূরণ করানোর ঘটনায় দুই শিক্ষককে আটক করা হয়েছিল। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আবারও এমন অনিয়ম প্রকাশ্যে আসায় শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি জনগণের উদ্বেগ বেড়েছে।
এইচএসসি পরীক্ষা জাতীয় জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এ পরীক্ষায় প্রতিটি নম্বর শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের উচ্চশিক্ষা ও পেশাগত জীবনের ভিত্তি গড়ে তোলে। সেখানে খাতা মূল্যায়নে এমন গাফিলতি কিংবা অনিয়ম বরদাশতযোগ্য নয়। শিক্ষা বোর্ডের প্রাথমিক পদক্ষেপ ইতিবাচক হলেও, অভিযুক্তদের দ্রুত তদন্ত ও যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা থেকেই যাবে। তাই সময়োপযোগী, নিরপেক্ষ ও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ