
ছবি: সংগৃহীত
চলতি বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, উচ্চপদস্থ আমলা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। আজ রোববার (২০ জুলাই) এই মামলার শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল আগামী ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত সময় মঞ্জুর করেছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য।
এই মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে আছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান, সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, শিল্পমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, এবং প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমু। পাশাপাশি, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরী, বেসরকারি খাত উন্নয়ন বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং কামাল আহমেদ মজুমদারসহ মোট ৪৫ জন অভিযুক্ত রয়েছেন।
আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে মামলাটির শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি তদন্ত কাজের অগ্রগতি ব্যাখ্যা করে আরও সময় চেয়ে আবেদন করেন। ট্রাইব্যুনাল তা বিবেচনায় নিয়ে আগামী ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত সময় মঞ্জুর করে এবং তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।
এ সময় আদালতে প্রসিকিউশন দলের অন্যান্য সদস্য ছাড়াও অভিযুক্তদের আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। আসামিপক্ষের কেউই জামিনে মুক্ত নয়; তাদের অধিকাংশই কারাগারে আটক অবস্থায় রয়েছেন, বাকিরা ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেছেন।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়া ছাত্র ও গণআন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রশাসন ও দলীয় কর্মীদের বিরুদ্ধে যে সহিংস অভিযান চালানো হয়, তাতে গণহত্যা, অপহরণ, জোরপূর্বক গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নারী নির্যাতন, বাড়িঘর পোড়ানোসহ অসংখ্য মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
এই সহিংসতার জন্য দায়ী হিসেবে তৎকালীন সরকার ও তাদের ঘনিষ্ঠ প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সহযোগীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, ভুক্তভোগী পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীদের পক্ষ থেকে বিপুল সংখ্যক অভিযোগ জমা পড়ে।
গত ১৭ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে এই মামলায় অভিযুক্ত ৪৫ জনের বিরুদ্ধেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল। এরপর থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অভিযুক্তদের ধরতে অভিযান শুরু করে।
তদন্ত সংস্থা ইতোমধ্যে ঘটনার বিভিন্ন স্থানে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী, চিকিৎসক, মানবাধিকার কর্মী ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে। তারা এ পর্যন্ত শতাধিক সাক্ষ্য, ভিডিও ফুটেজ, চিকিৎসা প্রতিবেদন এবং ময়নাতদন্তের নথিপত্র বিশ্লেষণ করেছে।
প্রসিকিউশন পক্ষ বলেছে, "এই মামলার গুরুত্ব ও পরিসর এতটাই বড় যে, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী তদন্ত করতে পর্যাপ্ত সময় দরকার। প্রাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ ও প্রাথমিক তথ্যেই মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের প্রবল প্রমাণ পাওয়া গেছে।"
এই মামলায় 'ডেথ স্কোয়াড'–এর কুশীলবদের বিচার দাবি করে ভুক্তভোগী পরিবার ও নাগরিক সমাজ দীর্ঘদিন ধরেই সোচ্চার। এখন আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এই ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়ার শুরুতে অনেকেই স্বস্তি প্রকাশ করেছেন।
অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, যিনি তখন সরকারপন্থী অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন বিতর্কিত সিদ্ধান্তের পেছনে ছিলেন বলে অভিযোগ আছে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর আলম এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকেও মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনাল স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে, এই মামলা বিচারের সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে পরিচালিত হবে, যাতে কোনো ধরনের পক্ষপাত বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আড়াল না থাকে।
গণতন্ত্রের নামে গণহত্যা ও নিপীড়নের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে এই মামলার প্রাথমিক নথিতে। দেশের ইতিহাসে এটিই প্রথম, যেখানে একটি ক্ষমতাসীন দলের সরকারের উচ্চপর্যায়ের নেতারা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছেন।
দেশ ও আন্তর্জাতিক মহল এই মামলার দিকে গভীর নজরে তাকিয়ে আছে।
তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল ও বিচার প্রক্রিয়া অগ্রসর হওয়ার মাধ্যমে আসলে সত্য, ন্যায়বিচার ও জবাবদিহির ভিত্তি কতটা শক্তিশালী—তা নির্ধারণ হবে।
আর সবচেয়ে বড় কথা, এই বিচার যেন হয় ভবিষ্যতের জন্য সতর্কতা ও ন্যায়বিচারের পথচিহ্ন, যা রাজনীতি ও মানবাধিকারের মাঝখানে মানবতাকে সর্বাগ্রে রাখে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ