
ছবি: সংগৃহীত
শ্রীলঙ্কা সফরে শুরুটা হতাশাজনক হলেও শেষটা ছিল রঙিন। সফরের শেষ ভাগে এসে টেস্ট ও ওয়ানডে সিরিজ হারানো টাইগাররা শেষ হাসি হেসেছিল টি-টোয়েন্টি সিরিজ জিতে। শ্রীলঙ্কার মাটিতে সেই ঐতিহাসিক সিরিজ জয়ের রেশ কাটতে না কাটতেই দেশের মাটিতে আরও এক চ্যালেঞ্জ—এইবার পাকিস্তান। আর সেই চ্যালেঞ্জের প্রথম পরীক্ষায় সফল বাংলাদেশ। শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথমটিতে সফরকারী পাকিস্তানকে ৭ উইকেটের বড় ব্যবধানে হারিয়েছে লিটন দাসের নেতৃত্বাধীন স্বাগতিকরা। আর এই জয়ের নায়ক ছিলেন তরুণ ওপেনার পারভেজ হোসেন ইমন, যিনি খেলেছেন ক্যারিয়ার সেরা এক ঝোড়ো ইনিংস।
বাংলাদেশ দল শ্রীলঙ্কা থেকে দেশে ফিরেছে মাত্র দুদিন আগে। প্রায় টানা সফরের পর বিশ্রামের পর্যাপ্ত সময় না পেলেও, পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ম্যাচে যেন নতুন উদ্যমে মাঠে নামে টাইগাররা। রোববার (২০ জুলাই) মিরপুরে অনুষ্ঠিত ম্যাচের আগে লিটন দাস টস জিতে নেন গুরুত্বপূর্ণ এক সিদ্ধান্ত—পাকিস্তানকে ব্যাট করতে পাঠানো।
শুরুটা অবশ্য পাকিস্তানের পক্ষে যায়নি। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই প্রথম উইকেট হারায় সফরকারীরা। বাংলাদেশের পেস আক্রমণের নেতৃত্বে থাকা তাসকিন আহমেদ তার প্রথম স্পেলে তুলে নেন সাইম আইয়ুবের উইকেট। মোস্তাফিজুর রহমানের হাতে সহজ ক্যাচ দিয়ে ১ রান করেই ফিরে যান পাকিস্তানি ওপেনার। এরপর একের পর এক ব্যাটার সাজঘরের পথ ধরেন।
পাকিস্তানের ইনিংস শুরু থেকেই ছিল বিশৃঙ্খল। প্রথম ওভারেই শুরুটা ভালো করলেও দ্বিতীয় ওভারে ছন্দ হারায় দলটি। এরপর একপ্রান্ত আগলে ব্যাট চালিয়ে যান অভিজ্ঞ ফখর জামান। তবে সঙ্গ দিতে পারেননি অন্যরা। হারিস, আগা সালমান, হাসান নাওয়াজ, ফাহিম আশরাফ কিংবা অভিষিক্ত সালমান মির্জা—সবাই ছিলেন ব্যর্থদের তালিকায়।
ফখর জামান খেলেন ৩৪ বলে ৪৪ রানের কার্যকরী ইনিংস, যার মধ্যে ছিল চারটি চার ও দুটি ছক্কা। কিন্তু রানআউট হয়ে ফেরার পর সেই ধস আর থামেনি। ২৩ বলে ১৮ রান করেন খুশদিল শাহ এবং ২৪ বলে ২২ রান আসে আব্বাস আফ্রিদির ব্যাট থেকে। বাকি কেউই দুই অঙ্কে পৌঁছাতে পারেননি।
সিরিজের প্রথম ম্যাচেই পাকিস্তানের দলীয় স্কোর মাত্র ১১০ রান, যা বাংলাদেশের বিপক্ষে তাদের টি-টোয়েন্টি ইতিহাসের সবচেয়ে কম রানের ইনিংস। তাসকিন আহমেদ ৪ ওভারে ۳ উইকেট নিয়ে ছিলেন বাংলাদেশের বোলিং লাইনআপের নেতৃত্বে। মোস্তাফিজুর রহমান মাত্র ৬ রান দিয়ে ২ উইকেট নিয়ে গড়েন রেকর্ড—টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে ৪ ওভারে সবচেয়ে কম রান দেওয়ার কীর্তি। তানজিম সাকিব ও মেহেদী হাসান পান একটি করে উইকেট।
শেষ ওভারে নাটকীয় ধসের মধ্য দিয়ে ১১০ রানেই অলআউট হয়ে যায় পাকিস্তান। তাসকিনের করা ইনিংসের শেষ ওভারে প্রথম তিন বলে পড়েছে তিনটি উইকেট—একটি ক্যাচ, একটি রানআউট ও একটি ক্যাচ।
জয়ের জন্য ১১১ রানের সহজ লক্ষ্য সামনে পেলেও শুরুটা একেবারেই ভালো হয়নি বাংলাদেশের। ইনিংসের প্রথম ওভারে ওপেনার তানজিদ হাসান তামিম আউট হয়ে ফেরেন মাত্র ১ রান করে। তাকে ফিরিয়ে পাকিস্তানকে এনে দেন সালমান মির্জা। পরের ওভারে একই বোলারের শিকার হন অধিনায়ক লিটন দাস। মাত্র ১ রান করে খুশদিল শাহের ক্যাচে পরিণত হন তিনি। ৭ রানে ২ উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে স্বাগতিক শিবির।
এই চাপ থেকে দলকে টেনে তোলেন তরুণ পারভেজ হোসেন ইমন ও মিডল অর্ডারের ভরসা তাওহীদ হৃদয়। এই জুটিই ছিল ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট। সাবলীল ব্যাটিংয়ে ৭৩ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়েন এই দুই তরুণ। ইমন ছিলেন আক্রমণাত্মক, আর হৃদয় ব্যাট করছিলেন ঠাণ্ডা মাথায়। দলের স্কোর যখন ৮০, তখন আব্বাস আফ্রিদির বলে বোল্ড হয়ে ফেরেন ৩৭ বলে ৩৬ রান করা তাওহীদ হৃদয়।
তাওহীদের বিদায়ের পর জাকের আলী অনিককে সঙ্গে নিয়ে বাকি কাজটুকু সম্পন্ন করেন ইমন। এক সময় ৩৪ বলে অর্ধশতক পূর্ণ করেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ৩৯ বলে ৫৬ রান করে অপরাজিত থাকেন। তাঁর ইনিংসে ছিল ৬টি চার ও ২টি ছক্কা। জাকের অনিক ১০ বলে ১৫ রান করে অপরাজিত থেকে দলের জয় নিশ্চিত করেন।
বাংলাদেশ জয় পেয়েছে ১৯তম ওভারের প্রথম বলেই। পাকিস্তানের দেওয়া লক্ষ্য ছুঁতে টাইগাররা খেলেছে মাত্র ৯৫ বল। পুরো ইনিংসে বাংলাদেশ হারায় মাত্র ৩টি উইকেট।
এই ম্যাচে বাংলাদেশের হয়ে যে ক’জন খেলোয়াড় উজ্জ্বল ছিলেন, তাদের মধ্যে মোস্তাফিজুর রহমান সবচেয়ে উজ্জ্বল। মাত্র ৬ রান দিয়ে ৪ ওভারে ২ উইকেট—এই পরিসংখ্যানই বলে দেয় তিনি কতোটা ভয়ঙ্কর ছিলেন। একই সঙ্গে নিজের বোলিং ক্যারিয়ারেও যুক্ত করেছেন আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে এক অনন্য রেকর্ড।
তাসকিন আহমেদ দারুণভাবে ফিরেছেন ফর্মে। বল হাতে নিয়েছেন ৩টি মূল্যবান উইকেট। আর ব্যাট হাতে পাকিস্তানকে নাস্তানাবুদ করেছেন ইমন ও হৃদয়। এ জয় শুধু সিরিজে এগিয়ে যাওয়ার আনন্দ নয়, বরং দেশের মাটিতে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ফেরার বার্তাও।
সিরিজে ১-০ তে এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। এখন লক্ষ্য দ্বিতীয় ম্যাচে জয় নিশ্চিত করে সিরিজ নিজেদের করে নেওয়া। পাকিস্তানের জন্য এটি বড় সতর্কবার্তা—তাদের ব্যাটিং লাইনআপে স্থিতিশীলতা না ফিরলে সিরিজ হাতছাড়া হওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার। অন্যদিকে বাংলাদেশের জন্য এটি ভবিষ্যতের পথচলায় বড় অনুপ্রেরণা।
বিশ্বকাপের আগে এমন ধারাবাহিক পারফরম্যান্সই চাইছে পুরো দেশ। আর সেই চাহিদা পূরণে যেন প্রতিটি খেলোয়াড় এখন একতাবদ্ধ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ