
ছবি: সংগৃহীত
দেশের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড বর্তমানে এক জটিল অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মূলত চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ হারানো, বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ না পরিশোধ এবং ব্যাংক ঋণ পরিশোধে অনিশ্চয়তা—এই ত্রিমাত্রিক চাপে কোম্পানিটি ব্যাপক আস্থাহীনতার মুখে পড়েছে।
বিশেষ করে প্রতিষ্ঠানটির সবচেয়ে বড় রাজস্ব-উৎপাদনকারী অংশ, নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)-এর নিয়ন্ত্রণ হারানো এবং চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি)-এর ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা, বিনিয়োগকারীদের আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এর ফলেই বাজারে সাইফ পাওয়ারটেকের শেয়ারদরে মারাত্মক পতন ঘটেছে এবং প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ এখন হুমকির মুখে।
১৫ বছরের বন্দর নিয়ন্ত্রণ শেষ, ব্যাংক ঋণ অনিশ্চিত
২০০৬ সাল থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি ও সিসিটি টার্মিনালের পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে কোম্পানিটি দ্রুত সম্প্রসারিত হয়। বন্দরের আধুনিকীকরণ এবং যন্ত্রপাতির রক্ষণাবেক্ষণে নেতৃত্বদানকারী এই প্রতিষ্ঠান পরবর্তী সময়ে নিজেকে বন্দরের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করে।
তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে বন্দরের কার্যক্রমে বিদেশি অপারেটর সংযুক্ত করার সিদ্ধান্তের কারণে ২০২৩ সালের শেষ দিকে এনসিটির নিয়ন্ত্রণ ফেরত নেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। যদিও সিসিটির চুক্তির মেয়াদ এখনো ২০২৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত রয়েছে, তারপরও বিনিয়োগকারীদের আশঙ্কা, এই চুক্তিও আর নবায়ন হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ড. খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, “যে কোনো কোম্পানির ওপর এতটা নির্ভরশীল ব্যবসার ভিত্তি ঝুঁকিপূর্ণ হয়। সাইফ পাওয়ারটেক শুধুই বন্দরনির্ভর হয়ে উঠেছিল। ফলে এখন নিয়ন্ত্রণ হারানোর পর এর ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও শেয়ারবাজার—উভয়ই তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
ব্যাংকিং খাতে চরম ঝুঁকি: প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনাদায়ী
ঢাকা ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইউসিবিএল, হজ ফাইন্যান্স ও প্রিমিয়ার লিজিং—এই আটটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান মিলে সাইফ পাওয়ারটেককে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে।
তাদের মধ্যে একমাত্র ন্যাশনাল ব্যাংকের ঝুঁকিই প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, যা প্রতিষ্ঠানটির মোট ঋণের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। ব্যাংক কর্মকর্তারা এখন উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন—এই ঋণ আদায় আদৌ সম্ভব হবে কি না।
একজন ব্যাংক বিশ্লেষক, নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “আমরা ১৬০০ কোটি টাকা দীর্ঘমেয়াদে দিয়েছি, সঙ্গে ৪০০ কোটি টাকার ওভারড্রাফট। কিন্তু এখন যখন কোম্পানিটির মূল আয়ের উৎসই বন্ধ হয়ে গেছে, তখন এই ঋণ রিকভারি হবে কিভাবে? ব্যাংকগুলোর জন্য এটা বিপজ্জনক সংকেত।”
বিনিয়োগকারীদের ক্ষোভ: লভ্যাংশ নেই, ভরসাও নেই
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি হিসেবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মাত্র ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেও এখনো তা পরিশোধ করতে পারেনি সাইফ পাওয়ারটেক। তিন কোটি ৭৮ লাখ টাকার এই লভ্যাংশ ছয় মাসেও না দেয়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়েছে।
বিনিয়োগকারী জাহিদ হাসান বলেন, “কোম্পানির রিজার্ভে ১৬৮ কোটি টাকা থাকলেও ১০ পয়সা লভ্যাংশ দিতে না পারা এক রকম প্রতারণা। এটা দেখেই বোঝা যায়, কতটা গভীর সংকটে পড়েছে সাইফ।”
অথচ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ৭০ পয়সা, আর নগদ প্রবাহ ছিল ১ টাকা ৮৮ পয়সা। শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য এখনো ১৭ টাকা এক পয়সা হলেও, বাজারে এই শেয়ারের দাম ১০ টাকার নিচে নেমে এসেছে।
ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অবস্থান
সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার মো. রুহুল আমিন বলেন, “আমরা পালিয়ে যাইনি। বরং মোকাবিলা করছি। এনসিটির দায়িত্ব হারানোর পর চ্যালেঞ্জ বেড়েছে ঠিক, তবে আমরা এখনও চেষ্টার মধ্যে আছি। আংশিকভাবে লভ্যাংশ পরিশোধ শুরু করেছি, বাকিটা খুব শিগগিরই দেওয়া হবে।”
তবে তার এই বক্তব্যে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তেমন আস্থা ফিরে আসেনি। অনেকেই দাবি করছেন, কোম্পানিটি বেশ কিছু প্রকল্পে অর্থ ব্যয়ের হিসাবও স্পষ্ট করছে না।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা নীরব
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এখনো এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়নি। কমিশনের মুখপাত্র আবুল কালামের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিএসইসি’র কার্যকর হস্তক্ষেপ জরুরি ছিল।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক মুজিবর রহমান বলেন, “শুধু সাইফ পাওয়ারটেক নয়, এভাবে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের টাকা আটকে রেখে বছরের পর বছর চালিয়ে যাচ্ছে। এটা বাজারের জন্য ভয়ানক বার্তা।”
ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি চায় বিনিয়োগকারীরা
চলমান সংকট শুধু সাইফ পাওয়ারটেক নয়, বরং বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও কোম্পানি গভর্ন্যান্সে দায়বদ্ধতার অভাবকেই সামনে তুলে এনেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মিত অডিট, বাস্তবসম্মত লভ্যাংশ নীতি এবং ঋণ ব্যবস্থাপনায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নাহলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়।
বর্তমানে সাইফ পাওয়ারটেক আর্থিক, প্রশাসনিক ও বাজারমূল্য—তিন দিক থেকেই চরম চাপে রয়েছে। যদি দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব কেবল একটি কোম্পানির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত, শেয়ারবাজার এবং বিনিয়োগ পরিবেশকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
সেইসঙ্গে এই ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে—কোনো প্রতিষ্ঠান যদি একটি মাত্র খাতে বা অংশীদারি ব্যবস্থার ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তাহলে সেই নির্ভরতার পতন তাকে ধ্বংসের দিকেই নিয়ে যেতে পারে।
বাংলাবার্তা/এসজে