
ছবি: সংগৃহীত
দেশের শিল্প ও বাণিজ্যক্ষেত্র দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে আটকে পড়েছে। মূল্যস্ফীতি, টাকার অবমূল্যায়ন, ডলার সংকট এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ব্যবসার খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা সৃষ্টি হওয়ায় নতুন বিনিয়োগ স্থগিত রয়েছে। ফলে দেশের শিল্প-বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড ঝাঁপিয়ে উঠতে পারছে না।
বাণিজ্যিক খাত সংকটে
শিল্প ও বণিক সমিতির ফেডারেশন (এফবিসিসিআই)-এর সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু কালের কণ্ঠকে বলেন, “গত বছরের ৫ আগস্টের পর দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকার কারণে শিল্প-বাণিজ্যে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, যা কয়েক লাখ শ্রমিকের বেকারত্ব বৃদ্ধি করেছে।”
তিনি আরও বলেন, “নীতিগত ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া দেশের বিনিয়োগ ও ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়ন সম্ভব নয়। স্থানীয় বিনিয়োগ না বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগও আসবে না। আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হলে ব্যবসায়ীদের আস্থা ফিরে আসবে না।”
তৈরি পোশাক খাতের মন্দা ও প্রভাব
দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পও সংকটে ভুগছে। বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, “রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নির্বাচনের অনির্দিষ্টতার কারণে নতুন বিনিয়োগ কমেছে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট এবং ঋণের উচ্চ সুদে অনেক কারখানা সাময়িক বন্ধ হয়েছে।”
বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক ও ট্রেড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান তুহিন জানান, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগামী ১ আগস্ট থেকে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ফলে ইউরোপ ও আমেরিকান বাজারে চাহিদা কমার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এতে রপ্তানিকারকরা উদ্বিগ্ন এবং বিনিয়োগ স্থগিত রেখেছেন।”
মূলধনী যন্ত্র আমদানি ও ঋণের সংকট
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ১১ মাসে দেশের মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি ১৯.৬ শতাংশ কমেছে। এ সময় মোট আমদানির পরিমাণ ছিল ২৬২ কোটি ২৪ লাখ ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হ্রাস।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ প্রবৃদ্ধি ৭.১৭ শতাংশে নেমে এসেছে, যা গত মাসের ৭.৫০ শতাংশ থেকে কম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঋণের উচ্চ সুদ ও টাকার মূল্যহ্রাসের কারণে বেসরকারি খাত ঋণপ্রবাহ সংকুচিত হয়েছে।
নীতিমূলক পরিবর্তনের দাবি
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার ৮.৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশ করার ঘোষণা দিয়েছে, তবে ব্যবসায়ীরা মনে করছেন এটি যথেষ্ট নয়।
বিটিএমএর সাবেক পরিচালক ও নরসিংদী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি রাশিদুল হাসান রিন্টু বলেন, “দেশে ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্য জরুরি। ব্যাংকিং খাতের সংস্কার ও স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে। সুদের হার কমিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ সহজলভ্য করা প্রয়োজন।”
তিনি আরও বলেন, “বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে স্পেশাল ইকোনমিক জোন ও রপ্তানি প্রক্রিয়া অঞ্চল বৃদ্ধি করতে হবে। তৈরি পোশাক ছাড়াও তথ্য প্রযুক্তি, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, ওষুধ শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রয়োজন।”
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি
অর্থনীতিবিদ ড. মঈনুল ইসলাম বলেন, “অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে ব্যবসা সম্প্রসারণ ও বিনিয়োগে সংকট দেখা দিয়েছে। টাকার অবমূল্যায়ন ও ঋণের উচ্চ সুদ ব্যবসার জন্য মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা।”
অন্যদিকে, বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ সায়ন্তন দাস বলেন, “রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া কোনও অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যকর হবে না। সরকারকে দ্রুত নিরপেক্ষ ও স্থায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের দিকে ফিরে আসে।”
সংকট নিরসনের পথ
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের শিল্প-বাণিজ্যের সংকট কাটাতে সরকারের উচিত—
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা,
ব্যাংকিং খাতে সংস্কার ও ঋণের সুদহার কমানো,
বিনিয়োগ বান্ধব নীতিমালা গ্রহণ,
রপ্তানি খাতের বহুমুখীকরণ,
নতুন প্রযুক্তি ও খাতের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা।
এবং পাশাপাশি বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পরিবহন খাতে সরবরাহ ব্যবস্থা শক্তিশালী করা জরুরি।
দেশের অর্থনীতি ও শিল্প-বাণিজ্যের সংকট মোকাবিলায় দ্রুত ও সুসংহত উদ্যোগ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন ও ব্যবসার প্রসার কঠিন হয়ে পড়বে। দেশের প্রধান শিল্প ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, অবিলম্বে পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য।
বাংলাবার্তা/এমএইচ