
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ইতিহাসে একটি দুঃখজনক ও দীর্ঘকালব্যাপী অধ্যায় জুড়ে রয়েছে একের পর এক প্রশিক্ষণকালীন বিমান দুর্ঘটনা। বিশেষ করে ১৯৯১ সাল থেকে শুরু করে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এই সময়কালে অন্তত ৩২টি বড় দুর্ঘটনার তথ্য পাওয়া যায়, যা কেবল সেনাবাহিনীর জন্য নয়, বরং সমগ্র জাতির জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে। এই দুর্ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই ঘটেছে প্রশিক্ষণ চলাকালে, যেখানে তরুণ ফ্লাইট ক্যাডেট বা অভিজ্ঞ স্কোয়াড্রন লিডারদের জীবন হারাতে হয়েছে।
প্রথম বড় ট্র্যাজেডি ঘটে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল, ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সময়। ওইদিন একসঙ্গে ধ্বংস হয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ৪০টি এফ-৬ যুদ্ধবিমান এবং ৪টি মিল-৮ হেলিকপ্টার। এটি ছিল একদিনে সবচেয়ে বড় বিমান ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা। এরপর থেকে প্রায় প্রতি দশকেই প্রশিক্ষণ বা অপারেশন চলাকালে বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে, যা শুধু বিমানবাহিনীর অপারেশন সক্ষমতা নয়, জননিরাপত্তা ও সুশাসন নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।
সবচেয়ে সাম্প্রতিক দুর্ঘটনা ঘটে ২০২৪ সালের ৯ মে, যখন ইয়াক-১৩০ নামের একটি প্রশিক্ষণ বিমান চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর মোহনায় বিধ্বস্ত হয়। এ ঘটনায় স্কোয়াড্রন লিডার মুহাম্মদ আসিম জাওয়াদ নিহত হন। এর এক বছর আগেই, ২০২৩ সালের কোনো এক সময়ে আরেকটি দুর্ঘটনা ঘটেছিল বলে সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলো উল্লেখ করেছে, যদিও সে তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত নয়।
২০১৮ সালে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে। ২৩ নভেম্বর টাঙ্গাইলে রকেট ফায়ারিং অনুশীলনের সময় বিধ্বস্ত হয় একটি এফ-৭ বিজি যুদ্ধবিমান। পাইলট নিহত হন। ওই বছরের ১ জুলাই কে-৮ ডব্লিউ প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় পড়ে দুই পাইলটের মৃত্যু ঘটে। আরও আগে, ২ জানুয়ারি মৌলভীবাজারে মিল এমআই-১৭ হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে কুয়েতি সামরিক কর্মকর্তাসহ কয়েকজন নিহত হন।
২০১৭ সালেও ভয়াবহ দুর্ঘটনার সাক্ষী হয় দেশ। ২৬ ডিসেম্বর দুটি ইয়াক-১৩০ কক্সবাজারে একযোগে বিধ্বস্ত হয়। এর আগে ১১ জুলাই চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় বিধ্বস্ত হয় আরেকটি ইয়াক-১৩০। পরবর্তী বছরগুলোতে এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে মিরসরাইয়ে জরুরি অবতরণের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমআই-১৭১এসএইচ হেলিকপ্টার। একই বছর ২৯ জুন পতেঙ্গা উপকূলে বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তাহমিদ। আর ১৩ মে এমআই-১৭১ হেলিকপ্টার শাহ আমানত বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণ হারান এক প্রশিক্ষক।
২০১৪ সালেও ঘটে দুটি পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমানের দুর্ঘটনা। ২০১৩ সালের ২০ মে যশোরে রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়ে এল-৩৯ প্রশিক্ষণ বিমান। একই বছরের ১৪ জুলাই বিধ্বস্ত হয় ন্যাঞ্ছাং এ-৫ যুদ্ধবিমান।
২০১২ সালে মধুপুরে বিধ্বস্ত হয় এল-৩৯ জেট ট্রেনার। নিহত হন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রেজা শরীফ। ২০১০ সালের ২০ ডিসেম্বর বরিশালে দুই স্কোয়াড্রন লিডার পিটি-৬ বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। একই বছর ২৩ সেপ্টেম্বর কর্ণফুলী নদীতে পড়ে যায় আরেকটি পিটি-৬।
২০০৯ সালেও তিনটি দুর্ঘটনা ঘটে। ২২ অক্টোবর বগুড়ায় পিটি-৬ বিধ্বস্ত হয়। ১৬ জুন এফটি-৬ যুদ্ধবিমান কর্ণফুলীতে বিধ্বস্ত হয়। ২০০৮ সালের ৮ এপ্রিল টাঙ্গাইলে বিধ্বস্ত হয় এফ-৭এমবি যুদ্ধবিমান, নিহত হন স্কোয়াড্রন লিডার মোরশেদ।
২০০৭ সালের ৯ এপ্রিল যশোরে বিধ্বস্ত হয় পিটি-৬। নিহত হন ফ্লাইট ক্যাডেট ফয়সাল মাহমুদ। ২০০৬ সালের ২৪ এপ্রিল ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে বিধ্বস্ত হয় আরেকটি পিটি-৬। নিহত হন ফ্লাইট ক্যাডেট তানজুল ইসলাম।
২০০৫ সালের ৭ জুন উত্তরায় একটি এফ-৭এমবি যুদ্ধবিমান এক বহুতল ভবনের সঙ্গে সংঘর্ষে পড়ে। একই বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি ঘটে আরেকটি পিটি-৬ দুর্ঘটনা।
২০০৩ সালে পাইপার সেসনা এস-২ এবং এফটি-৭বি বিধ্বস্ত হয় দুটি পৃথক ঘটনায়। ২০০২ সালে এমআই-১৭ হেলিকপ্টার উখিয়ায় এবং এ-৫সি যুদ্ধবিমান চট্টগ্রামে বিধ্বস্ত হয়। এতে প্রাণ হারান অন্তত পাঁচজন।
২০০১ সালে স্কোয়াড্রন লিডার মোহাম্মদ মহসিন নিহত হন একটি এফটি-৭বি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে। ১৯৯৮ সালে দুটি বড় দুর্ঘটনায় দুটি যুদ্ধবিমান সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। ১৯৯৬ সালে মিগ-২১ বিধ্বস্ত হয়, ১৯৯৪ সালে এফ-৭।
সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘর্ষ হয় ১৯৯৩ সালে, দুটি পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমানের সংঘর্ষে মারা যান তিন পাইলট। একই বছরে একটি এফটি-৫ বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কুদ্দুস।
এই দীর্ঘ তালিকা থেকে স্পষ্ট—দেশে যুদ্ধবিমান বা প্রশিক্ষণ বিমানের দুর্ঘটনা কোনো নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু উত্তরার মতো জনবহুল এলাকায় একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিধ্বস্ত হয়ে অসংখ্য শিশু-কিশোরের মৃত্যু, একটি সম্পূর্ণ নতুন স্তরে নিয়ে গেছে এই আশঙ্কাকে। প্রশ্ন উঠেছে, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এ ধরনের বিমান ওড়ানো কতটা নিরাপদ?
এখন সময় এসেছে একটি পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলার। শুধু তদন্ত প্রতিবেদন নয়, চাই প্রতিরোধমূলক কৌশল, পাইলটদের প্রশিক্ষণ আধুনিকীকরণ, এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর ওপর বিমান চলাচলে কড়াকড়ি। দুর্ঘটনাগুলো যেন পরিসংখ্যান না হয়ে দাঁড়ায়, বরং প্রতিটি প্রাণের মূল্য বিবেচনায় নিয়ে রাষ্ট্র যেন দায়িত্বশীলতার প্রমাণ দেয়—এই প্রত্যাশাই জাতির।
বাংলাবার্তা/এমএইচ